পশ্চিমা থ্রিলারের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ হ্যারি প্যাটারসন

৬ নভেম্বর ১৯৪৩, রাত ১টায় নাৎসি জার্মানির তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তি তথা এসএস বাহিনির সর্বময় কর্তা রাইখসফিউরার হাইনরিখ হিমলার-এর এসে পৌঁছোয় এক সাংকেতিক বার্তা। তাতে লেখা ‘দ্য ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড’, অর্থাৎ একদল জার্মান প্যারাট্রুপার ছদ্মবেশে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখতে সফল হয়েছে। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা কর্নেল কার্ট স্টাইনার-এর নেতৃত্বে এবং আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি-র প্রাক্তন সদস্য লিয়াম ডেভলিন-এর তত্ত্বাবধানে শত্রুদেশে অনুপ্রবেশ করা এই কমান্ডোদলের লক্ষ্য অসম্ভবকে সম্ভব করা— নরফোক খামারবাড়িতে ছুটি কাটাতে আসা ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল-কে অপহরণ করে বার্লিনে নিয়ে যাওয়া!

১৯৭৫ সালে প্রকাশের আলো দেখা ‘দ্য ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড’ জ্যাক হিগিনস ওরফে হ্যারি প্যাটারসন-কে (Harry Patterson) রোমাঞ্চপ্রেমীদের নয়নের মণি করে তুলেছিল, এ-কথা সর্বজনবিদিত। ১৯৫০ ও ’৬০-এর দশকে ‘দ্য গানস অফ ন্যাভারোন’, ‘হোয়্যার ঈগলস ডেয়ার’, ‘ফোর্স ১০ অফ ন্যাভারোন’-এর মতো কয়েকটি অনবদ্য ‘সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার থ্রিলার’ লিখে খ্যাতির শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছিলেন স্কটিশ লেখক অ্যালিস্টার ম্যাকলেন। পূর্বসূরির পথে হেঁটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেই তাঁর ম্যাগনাম ওপাস-এর প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নিলেন প্যাটারসন। বাস্তবের কিছু চরিত্র এবং ঐতিহাসিক সত্য ব্যবহার করে কাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্যতার মোড়ক পরালেন তিনি, ‘ফ্যাক্ট’ এবং ‘ফিকশন’-কে দক্ষ হাতে মিশিয়ে পাঠকের সামনে পরিবেশন করলেন এক অতীব সুস্বাদু থ্রিলার। তারপর যা ঘটল, তা প্যাটারসন-এর জবানিতেই বলা যাক—“ it changed the face of the war novel.”   

হ্যারি প্যাটারসন-এর জন্ম ২৭ জুলাই ১৯২৯, ইংল্যান্ড-এর নিউক্যাসল শহরে। ছেলেবেলার প্রায় গোটাটাই মায়ের সঙ্গে বেলফাস্ট, উত্তর আয়ারল্যান্ড-এ কাটিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন, মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্কুলের পাট চুকিয়ে নাম লেখান রয়াল হর্স গার্ডস রেজিমেন্ট-এ। তখন ঠান্ডা লড়াই সবে মাথাচাড়া দিয়েছে। অস্থির পূর্ব জার্মানি-র সীমান্ত অঞ্চলে তিন বছর পার করার পর বাহিনি থেকে ইস্তফা দেন প্যাটারসন। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস থেকে সোশিওলজি-তে স্নাতক হয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন, পাশাপাশি লেখালিখিতে মনোনিবেশ করেন।

প্যাটারসন-এর প্রথম উপন্যাস ‘স্যাড উইন্ড ফ্রম দ্য সী’ প্রকাশ পায় ১৯৫৯ সালে। অগ্রিম রয়্যালটি হিসেবে ৭৫ পাউন্ড ছিল বই লিখে তাঁর প্রথম উপার্জন। এরপর তাঁর কলম থেকে বছরপিছু গড়ে তিনটে করে থ্রিলার আসতে থাকে বাজারে। প্রথমের দিকে হ্যারি প্যাটারসন নামে লিখলেও ১৯৬২ থেকে ছদ্মনাম ব্যবহার শুরু করেন তিনি। ষাটের দশকে স্বনামে এবং মার্টিন ফ্যালন, হিউ মার্লো, জ্যাক হিগিনস ও জেমস গ্রাহাম ছদ্মনামে তিরিশটারও বেশি উপন্যাস লেখেন প্যাটারসন, যার মধ্যে ‘হেল ইজ টু ক্রাউডেড’ (১৯৬২),‘ইয়ার অফ দ্য টাইগার’ (১৯৬৩), ‘প্যাসেজ বাই নাইট’ (১৯৬৪), ‘দ্য গ্রেভইয়ার্ড শিফট’ (১৯৬৫), ‘ইস্ট অফ ডেসোলেশন’ (১৯৬৮), ‘আ গেম ফর হিরোজ’ (১৯৭০) উল্লেখের দাবি রাখে।

ক্রমশ অ্যাডভেঞ্চারধর্মী রোমাঞ্চের পরিচিত নাম হয়ে উঠলেও লেখক হিসেবে প্রকৃত সাফল্য প্যাটারসন-এর অধরাই থেকে যাচ্ছিল। সত্তরের দশকে নিজের লেখার ধরনে পরিবর্তন আনলেন তিনি, প্লটের চেয়ে জোর দিলেন চরিত্রায়নে। সুফলও পেলেন হাতেনাতে; ১৯৭২ ও ’৭৩ সালে প্রকাশ পাওয়া ‘দ্য স্যাভেজ ডে’ ও ‘আ প্রেয়ার ফর দ্য ডাইং’ অপেক্ষাকৃত ভালো বিক্রি হল, সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়োল। তারপর এল ‘দ্য ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড’-এর গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা। ১৯৭৬ সালে রুপোলি পর্দায় আলোড়ন তুলল এই উপন্যাস আশ্রয়ী সিনেমা। রবার্ট ডুভাল, মাইকেল কেইন ও ডোনাল্ড সাদারল্যান্ড-এর নিখুঁত অভিনয়, রুদ্ধশ্বাস সাসপেন্স এবং জমজমাট অ্যাকশন দৃশ্যের সমাহার মুগ্ধ করল দর্শকদের। প্রায় রাতারাতি থ্রিলারের মুকুটহীন সম্রাট হয়ে ওঠা প্যাটারসন অন্যান্য ছদ্মনামগুলোকে বিদায় জানালেন নির্দ্বিধায়, আঁকড়ে ধরলেন জ্যাক হিগিনস-এর ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’-কে। পাশ্চাত্য রোমাঞ্চ সাহিত্যের ইতিহাস এক নতুন যুগের সূচনা দেখল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে আরও একাধিকবার ফিরে গিয়েছিলেন হ্যারি প্যাটারসন। অপারেশন উইলি—লিসবন-এ ছুটি কাটাতে যাওয়া ডিউক অফ উইন্ডসর-কে সস্ত্রীক অপহরণ করার নাৎসি চক্রান্ত—র কাল্পনিক অথচ রুদ্ধশ্বাস বৃত্তান্ত ‘টু ক্যাচ আ কিং’ (১৯৭৯), আমেরিকান গ্যাংস্টার লুসিয়ানো-কে তুরুপের তাস হিসেবে কাজে লাগিয়ে জার্মানি অধ্যুষিত সিসিলি-তে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর টানটান আখ্যান ‘লুসিয়ানো’স লাক’ (১৯৮১), ফিল্ড মার্শাল এরউইন রোমেল-কে মুখ্য চরিত্রে রেখে রচিত থ্রিলার ‘নাইট অফ দ্য ফক্স’ (১৯৮৬), আটলান্টিক যুদ্ধকেন্দ্রিক স্পাই ফিকশন ‘কোল্ড হারবার’ (১৯৯০) রীতিমতো সাড়া জাগিয়েছিল পাঠকমহলে। ‘টু ক্যাচ আ কিং’ ও ‘নাইট অফ দ্য ফক্স’ পরবর্তীতে টেলিভিশন মুভি-ও হয়। ১৯৯১ সালে প্যাটারসন ‘দ্য ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড’ উপন্যাসের সিকোয়েল লেখায় হাত দেন। তবে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বাড়ানো প্লট, পাঠকপ্রিয় চরিত্রদের ফিরিয়ে আনার চমক ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও ‘দ্য ঈগল হ্যাজ ফ্লোন’ আগের বইয়ের ম্যাজিক-কে ছুঁতে পারেনি।

ছোটবেলায় বেলফাস্ট শহরে থাকাকালীন ‘আইরিশ ট্রাবলস’-এর বীভৎসতা নিজের চোখে দেখেছিলেন প্যাটারসন। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ, অখণ্ড আয়ারল্যান্ড-এর পক্ষে আন্দোলনরত নাগরিকদের ওপর ব্রিটিশ সেনার নির্মম দমন-পীড়ন, গুলি ও বোমার আঘাতে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কাগজে কলমে তুলে ধরেন তিনি, রচনা করেন নৈরাশ্যময় কিছু থ্রিলার। ‘ক্রাই অফ দ্য হান্টার’ (১৯৬০) বইয়ের ট্র্যাজিক নায়ক মার্টিন ফ্যালন, ‘আ ক্যান্ডেল ফর দ্য ডেড’ (১৯৬৬) উপন্যাসের আদর্শবাদী অথচ ভুল পথে পা বাড়ানো কেন্দ্রীয় চরিত্র শন রোগান, ‘টাচ দ্য ডেভিল’ (১৯৮২) নভেলের আদ্যোপান্ত রোম্যান্টিক কিন্তু নিয়তির আঘাতে জর্জরিত দুই হিরো মার্টিন ব্রসনান ও লিয়াম ডেভলিন-দের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মিল পাওয়া যায়: তাঁরা প্রত্যকেই “good guys fighting for rotten causes”, মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সর্বস্ব দিয়ে লড়েও জয়ের মুখ দেখে না, বিবেক যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে রয়ে যায় পরাজিতদের দলে। সে-কারণেই পাঠকের সহানুভূতি আদায়ে সক্ষম হয় তারা, সেরা থ্রিলার চরিত্রদের তালিকায় স্থান করে নেয় অনায়াসে।   

হঠাত শিরোনামে উঠে আসা কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনাকে উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করার মুন্সিয়ানা হ্যারি প্যাটারসন-এর মধ্যে পুরোমাত্রায় ছিল। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে ব্রিটেন ও আর্জেন্টিনা-র লড়াইয়ের আবহে ‘এক্সোসেট’ (১৯৮২) উপন্যাস লিখে যথেষ্ট প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জন মেজর ও তাঁর ক্যাবিনেট সদস্যদের হত্যার চেষ্টায় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে মর্টার হামলাকে উপন্যাসের রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা নিলেন প্যাটারসন, শিহরন জাগানো তথ্য ও আপন মনের মাধুরীর মিশেলে রচনা করলেন ‘আই অফ দ্য স্টর্ম’ (১৯৯২)। আত্মপ্রকাশ ঘটল এক নতুন হিরো-র, ব্যর্থ অভিনেতা, শখের দার্শনিক, প্রাক্তন আইআরএ বন্দুকবাজ ও ভাড়াটে খুনি শন ডিলান-এর। রোমাঞ্চ-রসিকরা বইটা পড়ে শিহরিত তো হলেনই, ডিলান-কে আপন করে নিতেও সময় নিলেন না। সফলতার নিশ্চিত রেসিপি চিনতে ভুল করল না প্যাটারসন-এর জহুরির চোখ, ডিলান-কে সিরিজ ক্যারেক্টার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলেন তিনি। ২০১৭ পর্যন্ত শন ডিলান-কে নায়ক চরিত্রে রেখে মোট বাইশটা বই লেখেন প্যাটারসন, বারবার বেস্টসেলার লিস্টে নাম তোলেন অনায়াসে। 

অ্যালিস্টার ম্যাকলেন-এর সঙ্গে হ্যারি প্যাটারসন-এর লিখনশৈলীর মিল যতটা, অমিল ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। নারী চরিত্র অঙ্কনে অত্যন্ত সাবলীল ছিলেন প্যাটারসন, কাহিনির প্রয়োজনে রোম্যান্স লিখতে দ্বিধা করেননি কখনও। সমালোচকরা তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যকর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাননি, এটা সত্যি। তাঁর উপন্যাসগুলোতে সাহিত্যগুণের অভাব রয়েছে এমন অভিযোগও সময়ে সময়ে উঠেছে। প্যাটারসন নিজে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যকে পাত্তা দেননি কখনও, প্রায়ই বলতেন—“I couldn’t see the point of writing books that didn’t make money”। কিন্তু এসত্ত্বেও নিজেকে নিরন্তর মাজাঘষার মাধ্যমে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার উদ্যম ও অধ্যাবসায় তাঁর মধ্যে ছিল। বিগত দশকগুলোতে লক্ষ কোটি পাঠক তাঁর বই পড়ে আইরিশ সিভিল ওয়ার-এর ধারণা পেয়েছেন, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার থ্রিলার ঘরানাকে ভালোবাসতে শিখেছেন, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেই। প্রয়াণবার্ষিকীতে পা রেখেও ভক্তদের অন্তরে অমর হ্যারি প্যাটারসন— এখানেই তাঁর মাহাত্ম্য, তাঁর সৃষ্টির অনন্যতা।

Powered by Froala Editor