ইতালির ভ্যাটিকান সিটি। স্বয়ং পোপের দেশ বলে কথা! কত স্থাপত্য, কত ইতিহাস, রহস্য-রোমাঞ্চে মোড়া। সেখানেই উপস্থিত হলেন এক বাঙালি যুবক। পোপের আসনে তখন বসে আছেন দশম পিউস। তাঁর সঙ্গেই সাক্ষাৎ হল এই যুবকের। উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর ঘটনা এটা, বাঙালি যুবকটি কী আলোচনা করবেন পোপের সঙ্গে! উনি তো ইংরাজিও বলবেন না। বাঙালি যুবকটি কী করবেন তাহলে? কিন্তু গল্প যে এখনও বাকি আছে, বন্ধু! পোপের সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট লাতিন ভাষায় তাঁকে অভিবাদন জানালেন বাঙালি যুবকটি। রীতিমতো অবাক তিনি! এতটাও আশা করেননি; কাজেই মুগ্ধ হতেও বেশি সময় লাগল না। কথার ফাঁকে পোপ দশম পিউস একবার বললেন ইতালীয় ভাষাটাও শিখে নিতে। পোপকে থামিয়ে এবার চোস্ত ইতালিয়ান ভাষাতেই কথা বলা আরম্ভ করলেন হরিনাথ দে!
মানুষের আবহমান ইতিহাসের ধারায় প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে ভাষা। একসময় সংকেতের আকারে যা শুরু হয়েছিল, পরে একটু একটু করে তা অক্ষরে পরিণত হয়। দেশ, রাজ্য, অঞ্চল বিশেষে তৈরি হয় ভাষার একেকটি নিজস্ব ধরণ। সেই ছাদের নিচেই দাঁড়িয়ে আছি আমরা। দাঁড়িয়েছিলেন এই মানুষটিও। তবে একটু অন্যভাবে। বাংলা তো বটেই, ভারতের ইতিহাসেও এমন বহু ভাষাবিদ মানুষ খুব কম। সেই ক্ষণজন্মাদেরই এক প্রতিনিধি হরিনাথ দে। জীবনের আয়ু স্বল্প হতে পারে; কিন্তু তাতেই যা কাজ করে গেছেন সেটাই অমর করে রাখবে। সেই ‘আনন্দ’ সিনেমার ডায়লগটার মতো, ‘বাবুমশাই, জিন্দেগি লম্বি নহি…’
সবজি কাটতে কাটতে ছোট্ট হরিনাথকে তরকারির খোসা দিয়ে বর্ণমালা চিনিয়েছিলেন মা। কিছুক্ষণ পর সেই খোসা আর কয়লা নিয়ে গোটা বাড়ি ভরিয়ে দিয়েছে বাংলা বর্ণমালায়। এভাবেই ভাষার সঙ্গে আত্মীয়তা হয়ে গিয়েছিল হরিনাথের। সে তো ছিল নিজের ভাষা, মাতৃভাষা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ঘটতে থাকে সেই ছোট্ট বয়স থেকেই। স্থানীয় চার্চ থেকে বাইবেল নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলেন। কয়েকদিন পর চার্চের ফাদার দেখেন, ছেলে গোটা বাইবেল হিন্দিতে অনুবাদ করে ফেলেছে!
এমন ভাবেই জীবনের নদী এগোচ্ছিল। হরিনাথের ভাষার প্রতি প্রেম দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। হাতের সামনে যা-ই নতুন ভাষা পাচ্ছেন, শিখে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই করে শিখে নিয়েছেন ভারতের চোদ্দোটি ভাষা! প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন হরিনাথ। পালি ভাষার এমএ পরীক্ষা চলছে। প্রশ্নপত্রে চোখ পড়তেই হঠাৎ আটকে গেলেন হরিনাথ। সামনে দেখছেন ‘ধনিয়সূত্ত’র একটি পাঠ। পালি ভাষার যথেষ্ট কঠিন একটি পাঠ এটি। এর উত্তর তিনি জানতেন। কিন্তু লিখতে পারছেন না। মাথায় ঘুরছে অনুবাদ। মাথায় উঠল পরীক্ষা। নিকুচি করেছে উত্তর লেখার! ধীরে সুস্থে পরীক্ষার হলে বসে সেই লেখাটা ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন হরিনাথ দে।
বিদেশি ভাষা জানতে ছুটে গেছেন নানা জায়গায়। গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, তিব্বতি, আরবি এমনকি মিশরীয় ভাষা পর্যন্ত শিখে নিয়েছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে ৩৪টি ভাষাকে আপাদমস্তক নিজের ভেতরে ধারণ করেছিলেন তিনি। তার সম্মানও পেয়েছেন বারবার। কলকাতার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির (বর্তমান ন্যাশনাল লাইব্রেরি) গ্রন্থাগারিকের পদেও ছিলেন তিনি। ইংরেজদের আমলে নিজের যোগ্যতায় এই পদ অর্জন করেছিলেন হরিনাথ। ঢাকা কলেজে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপনাও করতেন। তখনই লর্ড কার্জনকে একটি বই উপহার দেন তিনি। আরবি ও ফার্সি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছিলেন বইটি; আর উৎসর্গ লেখা ছিল ল্যাটিনে। এতেই হতবাক হয়ে যান কার্জন। এতই মুগ্ধ হন যে পরে নিজে ঢাকায় গিয়ে হরিনাথের সঙ্গে দেখা করেন। এখানেই জিতে যায় প্রতিভা, জিতে যায় পরিশ্রম।
এত পণ্ডিত ব্যক্তি, অথচ স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় সবসময় বকুনি খেতে হত মাস্টারমশাইদের কাছে। অঙ্ক ছিল তাঁর কাছে আতঙ্কের এক নাম! বন্ধুর বাবা তাচ্ছিল্য করছে, বাড়িতে বকুনি; এমনকি বিএ পরীক্ষাতে দর্শনে ফেল করেছিলেন! তবুও নিজের কাজেই নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন হরিনাথ দে। ভালোবাসতেন প্রচুর বই পড়তেও। আজ তাঁর সেই সংগ্রহশালা, সেই বইয়ের অধিকাংশই কোথায় চলে গেছে, কেউ জানে না। হরিনাথ নিজে ভেবেছিলেন, মাত্র ৩৪ বছরেই নিভে যাবে দেউটি! টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন অকালে। ডাক্তারদের হাজার চেষ্টাও প্রাণপাখি ধরে রাখতে পারল না। আর সেই সঙ্গে বাংলা হারিয়েছিল তার এক উজ্জ্বল সন্তানকে...
আরও পড়ুন
১০৬ বছরের দীর্ঘ জীবনে জেল খেটেছেন বারবার; 'মানভূম-জননী' লাবণ্যপ্রভা ঘোষকে আমরা চিনি?
তথ্যঋণ- আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘কঠিন প্রশ্নপত্রর প্রতিবাদে পরীক্ষায় বসেন শিক্ষকমশাইও’
Powered by Froala Editor