পুরুষদের সঙ্গে কুস্তি লড়তে এসেছেন এক মহিলা। আর তা দেখতেই মানুষের ভিড় জমে গেছে গোটা মাঠজুড়ে। আমির খান অভিনীত ‘দঙ্গল’ সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন, এই দৃশ্যের সঙ্গ সকলেই পরিচিত তাঁরা। ভারতের দুই কিংবদন্তি কুস্তিগির গীতা এবং ববিতা ফোগাটের জীবনের ওপর নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির প্রেক্ষাপট হরিয়ানা। তাতে ফুটে উঠেছে নব্বই দশকের ছবি। তবে মজার বিষয় হল, এরও প্রায় চার-পাঁচ দশক আগেই পুরুষের সঙ্গে এক মহিলা কুস্তিগিরের দ্বৈরথ দেখেছিল ভারতবর্ষ।
১৯৫৪ সাল। অকুস্থল বরোদা (Baroda)। সেবার পশ্চিম ভারতের অন্যতম কিংবদন্তি কুস্তিগির বাবা পেহেলওয়ানের সঙ্গে লড়তে নেমেছিলেন একজন মুসলমান মহিলা। না, কোনো প্রতিযোগিতার অংশ ছিল না এই লড়াই। বরং, এই দ্বৈরথের পিছনে দায়ী ছিল বেশ কিছু সামাজিক ট্যাবু। ঠিক যেমনটা দেখানো হয়েছে ‘দঙ্গল’ সিনেমাতেও। মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম না— এই প্রথাগত ধারণাকে ভাঙতেই এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বাজি ধরেছিলেন, যদি মল্লযুদ্ধে হেরে যান তবে বিবাহ করবেন কিংবদন্তি বাবা পেহেলওয়ানকে। কী হয়েছিল এই যুদ্ধের ফলাফল?
সে-কথা না হয় শেষে বলা যাবে। আপাতত পরিচয়পর্ব সেরে নেওয়া যাক। আমাদের গল্পের মুখ্য চরিত্র, অর্থাৎ এই মহিলা কুস্তিগিরের নাম হামিদা বানু (Hamida Banu)। বিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ ভারতের আলিগড়ের এক কুস্তিগির পরিবারে জন্ম হামিদার। ফলে, পারিবারিক রীতি অনুযায়ী কৈশোর থেকেই মল্লযুদ্ধ এবং শরীরচর্চার পথে পা রাখতে হয়েছিল তাঁকে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও অন্যান্য পুরুষ মল্লযোদ্ধাদের মতোই কঠিন থেকে কঠিনতর অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়েছিল হামিদাকে। এমনকি সে-সময় থেকেই পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে অংশ নিতেন হামিদা। কিংবদন্তি ও তাঁর পারিবারিক নথি অনুযায়ী বয়ঃসন্ধির সময় হামিদার ওজন ছিল ২৩৭ পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় ১০৭ কেজি! ফলে, হেভিওয়েট কুস্তিগিরদের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে অংশ নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হত না তাঁর।
অবশ্য হামিদার এই প্রারম্ভিক কেরিয়ার সীমাবদ্ধ ছিল পারিবারিক মহলেই। ১৯৩৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রেসলিং’ জগতে আত্মপ্রকাশ তাঁর। প্রথম লড়াই-ই লড়েছিলেন এক পুরুষের বিরুদ্ধে। লাহোরের কিংবদন্তি কুস্তিগির ফিরোজ খান। সে-বছর পাঞ্জাব থেকে দিল্লিতে কুস্তি লড়তে এসেছিলেন তিনি। দিল্লির একাধিক কুস্তিগিরকে পরাস্ত করে যথেষ্ট খ্যাতিও আদায় করেন তিনি। সে-সময়ই তাঁর কাছে আসে হামিদার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ লড়ার প্রস্তাব। তাঁর সঙ্গে লড়তে আসবেন একজন মহিলা কুস্তিগির— ব্যাপারটা প্রথমে হাস্যকরই লেগেছিল ফিরোজের। আশ্চর্যকরও। কারণ, সে-সময় পরাধীন পারতে, রেসলিং রিং-এ পা রাখা নিষিদ্ধ মহিলাদের জন্য। পাসাপাশি হামিদা একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মহিলা। পর্দা প্রথাকে অস্বীকার করে একজন মুসলিম মহিলা কুস্তি লড়ছেন এমনটা স্বপ্নে ভাবাও বেশ কঠিন ছিল তৎকালীন সমাজে। কাজেই হামিদার এই চ্যালেঞ্জকে ততটাও পাত্তা দেননি ফিরোজ খান। কুস্তির ময়দানে কড়ায়-গণ্ডায় যার হিসেব দিতে হয়েছিল তাঁকে। জয়ের হাসি হেসেছিলেন হামিদা।
সেই শুরু। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। দিল্লি ছেড়ে পাঞ্জাবের আখড়ায় অনুশীলন শুরু করেন হামিদা। অমৃতসর থেকে লাহোর— সে-সময় অবিভক্ত পাঞ্জাবের বিভিন্ন মল্ল প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি। অবশ্য তাঁর এই উত্থানকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেনি রক্ষণশীল সমাজ। কানাঘুষো খবর ছড়িয়ে পড়ে, জনসমক্ষে ক্রীড়া পোশাক পরে মল্লযুদ্ধ লড়ে ইসলামকে কলঙ্কিত করছেন হামিদা। প্রতিদিনই তীর্যক শব্দবাণে বিদ্ধ হতে হত তাঁকে। পরবর্তীতে দানা বাঁধে তীব্র প্রতিবাদ। ফলস্বরূপ পাঞ্জাব থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন হামিদা। তবে লড়াই ছাড়েননি তিনি।
পরবর্তী এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কুস্তি লড়েছেন হামিদা। এমনকি ইউরোপীয় কুস্তিগির এবং বক্সারদের সঙ্গেও লড়েছেন একাধিক ম্যাচ। তৎকালীন ইংরাজি সংবাদপত্রে হামেশাই প্রকাশিত হত তাঁর ছবি, বীরত্বের কাহিনি। এমনকি তাঁকে ‘আমাজন অফ দ্য আলিগড়’ তকমা দিয়েছিল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। নথি অনুযায়ী, ভারতে ৩২০টি বাউট জিতেছিলেন হামিদা।
অবশ্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যে তাঁকে শুধু খ্যাতির চুড়োয় বসিয়েছিল, এমনটা না। বরং, চল্লিশের দশকের শেষ থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গুজব ছড়াতে থাকে তাঁর নামে। প্রকাশিত হয়, হামিদা শপথ নিয়েছেন, মল্লযুদ্ধের ময়দানে তাঁকে যে পুরুষ পরাজিত করবে তাঁকেই বিবাহ করবেন তিনি। দাবানলের বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল এই ‘মুখরোচক’ সংবাদ। সাড়া পড়ে গিয়েছিল সমাজেও। এমনকি শেষ পর্যন্ত সমাজের চাপেই তাঁকে মল্লযুদ্ধের ময়দানে নামতে হয়েছিল তৎকালীন ভারতের অন্যতম কুস্তিগির বাবা পেহেলওয়ানের বিরুদ্ধে। শর্ত রেখেছিলেন, মল্লযুদ্ধে বাবা পেহেলওয়ান হারলে, কুস্তির জগৎ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে তাঁকে।
হ্যাঁ, সেবারেও শেষ অবধি জয়ের হাসি হেসেছিলেন হামিদা। মাত্র ১ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডে তিনি ধরাশায়ী করেছিলেন ভারতসেরা কুস্তিগিরকে। কুস্তির জগৎ থেকে অবসর নিতে বাধ্য হন বাবা পেহেলওয়ান। হামিদা নিজেও আর মল্লযুদ্ধের ময়দানে নামেননি কোনোদিন। বলতে গেলে শুধু ভারতসেরা কুস্তিগিরকে হারানোই নয়, জীবনের শেষ লড়াই-এ দৃঢ় সংকল্প হামিদার কাছে হার মেনেছিল সমাজের প্রথাগত স্টেরিওটাইপ ও কুসংস্কাররা। তারপর?
১৯৫৪ সালে বরোদায় আয়োজিত এই ঐতিহাসিক মল্লযুদ্ধের পর সংবাদমাধ্যম থেকে হারিয়ে যান হামিদা। ইতিহাসও কি মনে রেখেছে ঔপনিবেশিক ভারতের কিংবদন্তি এই মহিলা মল্লযোদ্ধাকে? তবে এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, মহিলারাও যে কুস্তির জগতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে, স্বাধীনতার আগেই তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি। এর কয়েক যুগ পর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আনুষ্ঠানিকভাবে সোনা জয় গীতা-ববিতা-সাক্ষীদের। সেদিক থেকে হামিদাই তাঁদের পূর্বসূরি।
Powered by Froala Editor