পাঁচ মাস ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে কোভিড ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া। অথচ তার মধ্যেই একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গ। গতবছরের চেয়েও কোনো কোনো দেশে তার ভয়াবহতা অনেক বেশি। ভারতে তো বটেই। তাহলে কি প্রতিষেধক ঠিকঠাক কাজ করছে না? এই অভিযোগ অবশ্য চিকিৎসকরা মানতে রাজি নন। কারণ পরিসংখ্যান বলছে প্রতিষেধকের কার্যকারিতা যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা থেকে যাচ্ছে ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়াতেই। সম্প্রতি সাংবাদিক সম্মেলনে এমনটাই জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে অন্তত ১০০ কোটি মানুষ প্রতিষেধক পেয়েছেন এই ৫ মাসে। কিন্তু এর অর্ধেক পেয়েছেন মাত্র তিনটি দেশের মানুষ। ধনী দেশগুলিতে ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া যথেষ্ট সফলভাবে সম্পন্ন হলেও দরিদ্র দেশগুলি আজও ভ্যাকসিনের অভাবে ভুগছে। সমগ্র বিষয়টি নিয়ে জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
পরিসংখ্যান বলছে করোনা প্রতিষেধকের সবচেয়ে বেশি ডোজ পেয়েছেন আমেরিকার মানুষ। সেখানে ২২৫.৬ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এরপর চিন এবং ভারতের অবস্থান থাকলেও দুই দেশের জনসংখ্যার নিরিখে তা বেশ কম। চিনের মানুষ পেয়েছেন ২১৬.১ মিলিয়ন ডোজ। আর ভারত অনেকটাই পিছিয়ে। মাত্র ১৩৮.৪ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন ভারতবাসী। অবশ্য এর চেয়েও বেশি আশ্চর্যের কথা, এখনও পৃথিবীতে ১১টি দেশে ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। এর মধ্যে ৭টি দেশ রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। ৩টি ওসিয়ানিয়া মহাদেশে। এবং একটি দেশ ক্যারিবিয়ার হাইতি। ১১টি দেশে প্রতিষেধক না পৌঁছনোর একমাত্র কারণ, সেদেশের সরকারের করোনা প্রতিষেধক কেনার আর্থিক সামর্থ্য নেই।
নাগরিক জনসংখ্যার হিসাবে ইজরায়েলের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ প্রতিষেধক পেয়েছেন। এরপরেই আরব, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং চিলিতে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ প্রতিষেধক পেয়েছেন। বাকি দেশগুলির অবস্থা এখনও ইতিবাচক নয়। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে থাকা দেশগুলির কোথাও কোথাও ২৫ শতাংশেরও কম মানুষ প্রতিষেধক পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালির মতো দেশও রয়েছে। আর ভারতে তো ১০ শতাংশেরও কম মানুষ এখনও পর্যন্ত প্রতিষেধক পেয়েছেন। তবে আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশে ১ শতাংশেরও কম মানুষ প্রতিষেধক পেয়েছেন বলে জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
আরও পড়ুন
করোনার একাধিক স্ট্রেন সক্রিয় ভারতে, হার মানছে অ্যান্টিবডিও
সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয় ধনী দেশগুলিতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন প্রতিষেধক পেলেও দরিদ্র দেশগুলিতে সংখ্যাটা প্রতি ৫০০ জনে একজন। আর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই মহামারী প্রতিরোধ করতে গেলে এই বৈষম্য দূর করতেই হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন জানাচ্ছে, ইতিমধ্যে অন্তত ১০০টি দেশ ভ্যাকসিনের পেটেন্ট সাময়িক স্থগিত রাখার আবেদন জানিয়েছেন। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটের সমস্ত আইন বজায় রেখেও এই জরুরি পরিস্থিতিতে তা অসম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছে ডব্লিউটিও। কিন্তু ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি কোনোভাবেই সেই আবেদন মানতে রাজি নয়। ফলে নির্দিষ্ট মূল্য দিতে না পেরে অনেক দেশই প্রতিষেধক পাচ্ছে না।
আরও পড়ুন
ইজরায়েলে একদিনে করোনায় মৃতের সংখ্যা শূন্য, ১০ মাসে প্রথম
এছাড়াও বাজার চলতি বিভিন্ন প্রতিষেধকের মধ্যে কার্যকারিতার পার্থক্য তো থাকছেই। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা-র তৈরি প্রতিষেধক। অথচ দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় তরঙ্গের সংক্রমণ ঠেকাতে এর কার্যকারিতা ৬০-৭০ শতাংশের বেশি নয়। তবে ১৫৬টি দেশে মানুষ এই প্রতিষেধকই পাচ্ছেন। আর ফাইজার বা বায়োএনটেক সংস্থার তৈরি প্রতিষেধকের কার্যকারিতা যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি, সেখানে মাত্র ৯১টি দেশের মানুষ এই দুই প্রতিষেধক পাচ্ছেন। তার একমাত্র কারণ দুই প্রতিষেধকের দামের পার্থক্য। হ্যাঁ, শুধুই অর্থনৈতিক কারণেই এই মহামারী রুখতে অন্তত ১০ বছর লেগে যাবে বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে সাময়িক মুনাফার কথা অগ্রাহ্য করলেই পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেওয়া সম্ভব। মানুষের জীবনের মূল্য কি ব্যবসায়ীদের কাছে এতটাই সস্তা? বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নই উঠছে বারবার।
আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত মানবতাবাদী নেতা মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন খান
Powered by Froala Editor