কবিতা লেখে কিশোর ছেলেটা, কিন্তু লুকিয়ে রাখে। একদিন কী হল, তার বাবা জেনে ফেললেন যে ছেলের লেখার বাতিক আছে। লুকিয়ে পড়েও দেখলেন। এত অবধি ঠিক আছে, কিন্তু তারপর তিনি যেটা করলেন, গড়পড়তা বাঙালি মনে হয় না তা করবে।
ছেলের নাম গুস্তাভ। আলাদা ক’রে তাকে ডেকে বাবা মিস্টার জানুখ বললেন, ‘বুঝলি, ঐ লেখাগুলো পড়েছি। ভালোই তো লিখিস। ডক্টর কাফকাকেও আমি পড়তে দিয়েছি। উনিও, তোদের ঐ লেখাটেখা ভালোই বোঝেন।’
‘ডক্টর কাফকা কে বাবা?’ ছেলে শুধোল।
‘ম্যাক্স ব্রডের বন্ধু। ম্যাক্স নিজের বইটা তো ওনাকেই উৎসর্গ করেছে।’
‘সে কী! উনিই তো ‘মেটামরফোসিস’ লিখেছেন! আমি পড়েছি, দারুণ গল্পটা। তুমি চিনলে কী করে?’ ছেলে ভীষণ অবাক।
‘উনি আমাদের অফিসে কাজ করেন। আইন দপ্তরে আছেন।’
‘আচ্ছা! আমার লেখা পড়ে কী বললেন?’
‘বললেন ভালো হয়েছে। প্রথমে ভাবলাম ভদ্রতা ক’রে বলছেন, তারপর দেখলাম, তা নয়। আমাকে বললেন তোকে একবার নিয়ে যেতে ওর কাছে।’
বাবার সঙ্গে একটু ভয়ে ভয়েই গেছিল গুস্তাভ। সেই দিনের কথা সে পরে জানাচ্ছে, ‘মানুষটা রোগা আর লম্বা, কালো চুল ব্যাক ব্রাশ করে আঁচড়ানো। হাড়সর্বস্ব নাক, উঁচু কপাল, ধূসর-নীল চোখ। ঠোঁটে একটা তিক্ত হাসি। আমায় দেখেই হাত বাড়িয়ে দিলেন।’
আরও পড়ুন
হত্যাকারীর মধ্যেই খ্রিস্টকে খুঁজেছিলেন দস্তয়েভস্কি
তাহলে ইনি-ই হচ্ছেন গ্রেগর সামসা-র স্রষ্টা, মনে মনে নিজেকে বলছে গুস্তাভ, ভাবাই যায় না এঁকে সামনে থেকে দেখছি!
আরও পড়ুন
‘বেঞ্চের ওপর ঐ ছাতাটি রয়েছে’ – তক্ষুনি লিখে দিলেন বিনয়; হারিয়ে গেছে সেই কবিতাও
গুস্তাভের সঙ্গে বেশ দোস্তি হয়ে গেছিল কাফকা-র। বেশ ঘনঘনই দেখা হত তাদের। সেই সমস্ত সাক্ষাতের বিবরণ গুস্তাভ জানুখ লিখে রাখবেন ‘কনভারশেসন উইদ কাফকা’ বইতে। ‘তখন ১৯২০ সাল’, তিনি জানাচ্ছেন, ‘তাঁর সঙ্গে আমার যখন প্রথম সাক্ষাৎ হল।’
আরও পড়ুন
ভূমির কাছেই ফিরতে চেয়েছিলেন কবি বীতশোক ভট্টাচার্য
এমনিতে গম্ভীর হলেও আসলে রসিক লোক ছিলেন কাফকা। মজা করতেন প্রায়ই এবং সেই মজাগুলো ছিল শ্লেষাত্মক, মেধাবী ধরণের। চমৎকার কথা বলতেন এবং খুব গুছিয়ে বলতেন। গুস্তাভ ছোকরা বলে হেলাফেলা করতেন না, সমবয়সীর মতোই গুরুত্ব দিতেন।
১৯১৭ সাল থেকেই কাফকা ভুগছিলেন যক্ষ্মায়, আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন অফিসের কাজ থেকে।
একদিন হাঁটতে হাঁটতে কাফকার বাড়ি অবধি চলে এসেছে তারা। সুদৃশ্য ঘর-দালান দেখে বেশ অবাকই হয়েছে গুস্তাভ।
‘আরে! আপনি তো ভীষণ বড়লোক!’
‘ধুস! কী যে বলো।’ কাফকা আপত্তি করলেন, ‘বড়লোক ব্যাপারটা হচ্ছে আপেক্ষিক। ধরো কারো কাছে একটা পুরোনো জামা আছে, সেটাই তার কাছে অনেক। আবার এক গাদা জামা নিয়েও কেউ সন্তুষ্ট নয়। তাহলে তো সে গরিব হয়ে যায়! ...এই যে বাড়িঘর সব দেখছ, এগুলো মোটেই আমার সম্পত্তি নয়। সবই আমার পরিবারের।’
তারা হয়তো আরো কিছুক্ষণ কথা বলত, সেটা আর হল না। গুস্তাভ দেখল, পাঁচ হাত দূরে একজন দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। গম্ভীর মুখ। তিনি কথা বললেন বেশ উঁচু গলাতেই।
‘ফ্রানৎস, ঘরে যাও। আবহাওয়া ভালো নয়। ঠান্ডা লাগবে তোমার।’
গুস্তাভ তাকাল কাফকার দিকে। নরম গলায় আস্তে ক’রে কাফকা বললেন, ‘আমার বাবা।’
ইনিই প্রখ্যাত ব্যবসায়ী হেরমান কাফকা, বুঝতে পারল গুস্তাভ। কাফকা যে এই বয়সেও এতটা সমঝে চলেন বাবাকে, সে আন্দাজ করতে পারেনি।
‘বুঝলে কিনা, বড্ড চিন্তা করেন আমাকে নিয়ে’, কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করেই বললেন কাফকা, ‘অতিরিক্ত ভালোবাসা... তা একটু অত্যাচারের মতোই লাগে বটে। ইয়ে, এখন চলি। আবার দেখা হবে, অ্যাঁ?’
গুস্তাভ ঘাড় ঝোঁকালো। তার সঙ্গে হাত না মিলিয়েই ঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছেন বাধ্য ছেলে ফ্রানৎস।
‘দেখা হত প্রায়ই। কিন্তু তাঁর লেখা নিয়ে তেমন একটা কথা হত না। হলেও তা খুব সংক্ষেপেই’, লিখছেন গুস্তাভ।
‘শুনলেন’, কিশোর পড়ুয়া জানাল কাফকাকে, ‘আপনার ঐ ‘ভারডিক্ট’ গল্পটা পড়ছিলাম।’
‘ও। ভালো লেগেছে?’ শুধোলেন কাফকা।
‘লাগবে না? কী যে বলেন। দারুণ গল্প!’
‘হু। ঠিকই’, বললেন কাফকা, ‘ঠিকই বলেছ।’
‘আমাকে একটু বলুন না গল্পটা নিয়ে। আপনার মুখে শুনি’, আবদার করল সে।
‘ওটা হচ্ছে গিয়ে একটা রাতের ভূত’, হেসে বললেন কাফকা।
‘ভূত? মানে?’
‘ভূতই। রাতের বেলায় এল। দেখলাম ওর একটু ঝাড়ফুঁক দরকার। তাই আর কী, লিখতে হল।’
গুস্তাভ তো হাঁ। আর কিচ্ছুটি না বলে মুখে কুলুপ দিলেন কাফকা।
আরেকদিনের কথা। কথায় কথায় গুস্তাভ শুধিয়েছে, ‘আচ্ছা, ইয়ে, গ্রেগর সামসা আর ফ্রানৎস কাফকা, দুটো নাম কিন্তু খুব কাছাকাছি। মানে, বলছিলাম, আসলে আপনিই কি...’
কাফকা মাথা নাড়লেন, ‘বড্ড সোজা করে ভাবছ হে। তা নয়।’
আরো কিছুক্ষণ কথা হল। কাফকা প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইছেন, আসলে নিজের লেখা নিয়ে বলতে চান না।
কিশোর হাল ছাড়েনি। ‘মানে... বুঝলেন, গল্পটায় ভালো-মন্দ ওভাবে তো আলাদা করা নেই, পড়লে কেমন দুঃস্বপ্ন মনে হয়। মানে, বলতে চাইছি...’
‘এই যে স্বপ্ন, যার কথা তুমি বলছ, এতেই বাস্তবকে বোঝা যায়। এই জিনিসটাই হচ্ছে জীবনের ভয়, শিল্পের আতঙ্ক,’ বললেন কাফকা।...
এই গুস্তাভ-ই পরে সংগীতজ্ঞ হিসেবে নাম করবেন। কিশোর বয়সে তিনি অনেক লিখতেন, লেখক হওয়ারও একটা ইচ্ছে ছিল। বড় হতে সঙ্গীতের দিকে ঝোঁক চলে যায়।
১৯৫১ সালে বেরিয়েছিল তাঁর ‘কাফকা-র সঙ্গে কথাবার্তা’ নামে পাতলা বইটি। যতদূর জানা যায়, এছাড়া আর কোনো বই লেখেননি ভদ্রলোক।
বাড়িতে তখন খুব অশান্তি, বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় গুস্তাভের পাগল-পাগল অবস্থা। একদিন সে দেখা করছে কাফকার সঙ্গে।
তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করছেন বয়স্ক বন্ধুটি।
‘এসব ঝঞ্ঝাট এড়াতে যেও না, কারণ পারবে না এড়াতে। বরং খুব নজর ক’রে এদের দেখো, খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ যখন পেয়েছ। শান্ত থেকো, কক্ষনো ধৈর্য হারিও না। যত খারাপই হোক, যা-ই হোক, তোমার ওপর দিয়ে চলে যেতে দাও। জীবনে বড় হতে পারবে।’
১৯২৪ সাল। যক্ষ্মার শেষ দশা চলছে। স্যানাটোরিয়ামের বিছানায় রক্তবমি করতে করতে মারা গেলেন কাফকা। জুন মাসের তিন তারিখ। গুস্তাভ লিখছেন, ‘আমি খবরটা পাই কুড়ি তারিখ নাগাদ, এক চিত্রকর বন্ধুর লেখা চিঠিতে।’
...‘আমার বিছানার ঠিক পাশেই বাবার ছবিটা টাঙানো ছিল। সেটার দিকে তাকালাম। ১৯২৪ সালের মে মাসে, ১৪ তারিখে আমার বাবা আত্মহত্যা করেন।’
...‘তার ঠিক একুশ দিন পর, কাফকা মারা যান। তেসরা জুন।’
১৯৬৮ সাল অবধি বেঁচেছিলেন গুস্তাভ। মারা যান প্রাগ শহরেই। সারা জীবনে কখনোই এই দুটো তারিখ তিনি ভুলতে পারেন নি।
প্রিয় বাবাই ছেলেকে প্রথম নিয়ে গেছিলেন সহকর্মী ডক্টর কাফকা-র কাছে।
‘একুশ দিন পর...
একুশ দিন...
তখন আমার ঠিক একুশ বছর বয়স। আমার যৌবনের দুটো দিগন্ত ছিল, আবেগ আর মননের। সেই বছরে দুটোই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল।’
‘Conversations With Kafka’
Gustav Janouch, Tr. Goronwy Rees
Derek Verschoyle
Powered by Froala Editor