একটিমাত্র বই দিয়ে শুরু ব্যবসা, দিনে-দিনে বাংলার এক নম্বর প্রকাশনা হয়ে উঠেছিল ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’

২০৩/১/১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, কলিকাতা – ৭০০০০৬। আজ এই ঠিকানাটা শুনলে চট করে কেউ চিনবেন না। শহর কলকাতার অজস্র সাধারণ ঠিকানার একটি হয়েই টিকে আছে। অথচ এই ঠিকানাতেই একসময় ছিল বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা সংস্থা। ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’-এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই! গত শতকের প্রথমার্ধে তাবড় তাবড় সাহিত্যিকদের বই বেরোত এই প্রকাশনা থেকেই। এমনকি, সেসময়ের শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা সংস্থা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

অথচ এই প্রকাশনার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রথম জীবনে গুরুদাস হিন্দু হোস্টেলের একজন কর্মচারী ছিলেন। সেই ছাত্রাবাসে তখন বসবাস করতেন বেশ কয়েকজন ডাক্তারির ছাত্র। তাঁদের কথা মাথায় রেখেই, হোস্টেলের মধ্যে একটি ছোট আলমারিতে তিনি দুর্গাদাস করের লেখা ‘মেটেরিয়া মেডিকা’ রাখতে শুরু করেন। গুরুদাসের ব্যবসার শুরু সেখানেই। পরবর্তীকালে তিনি কলেজ স্ট্রিটে একটি ছোট ঘর ভাড়া নেন এবং বইভর্তি আলমারিটি সেখানে স্থানান্তরিত করেন। একই সঙ্গে, রজনীকান্ত গুপ্তের লেখা ‘সিপাহীযুদ্ধের ইতিহাস – প্রথম খণ্ড’ বইটিও সেখানে রাখেন তিনি। এসব ১৮৭৬ সালের কথা। প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর দোকান ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী।’

তাঁর সততা ও সুনামের জন্য সে-যুগের অনেক তাবড় সাহিত্যিকই আস্তে আস্তে তাঁর দোকানে যাতায়াত শুরু করলেন। গুরুদাসের বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী আস্তে আস্তে হয়ে উঠল কলকাতার অন্যতম পুস্তকালয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ সাহিত্যিকদের বই পাওয়া যেত এখানে। পসার জমে উঠলে, গুরুদাস ১৮৮৫ সালে ২০১ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের বাড়িটি ক্রয় করে সেখানে স্থানান্তরিত করলেন তাঁর দোকান।

আস্তে আস্তে দোকানের পাশাপাশি প্রকাশনা সংস্থা খোলার দিকে মন দেন গুরুদাস। ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী’ তখন বাংলা প্রকাশনার জগতে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। জলধর সেন, পাঁচকড়ি দে, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী, রজনীকান্ত সেন, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখের বইয়ের প্রকাশক তখন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। গত শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রকাশনার নাম বদলে হয় ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স।’ তাতে জনপ্রিয়তায় ভাটা তো পড়েইনি, বরং বেড়েছিল আরও।

১৯১২ সালে বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী থেকে মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা হয়। সম্পাদনা করার কথা ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের। কিন্তু তাঁর অকালপ্রয়াণ সেই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সম্পাদনার দায়িত্ব নেন জলধর সেন, তারপর ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।  

গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় মারা যান ৮১ বছর বয়সে, ১৯১৮ সালে। শোনা যায়, শেষ দশ বছর তিনি দৃষ্টিহীন হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সন্তানরাই ব্যবসার হাল ধরেন তখন।

বিশের দশকেই, কার্যত বাংলার অন্যতম সেরা প্রকাশনা সংস্থা হয়ে ওঠে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স। এখান থেকেই প্রকাশিত হত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমস্ত বই। এছাড়াও অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবী, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ তো ছিলেনই! পাশাপাশি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সতীশচন্দ্র মিত্র, দিলীপকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় – নামী লেখকদের কমতি ছিল না।

প্রকাশনার দায়িত্বে তখন গুরুদাসের উত্তরসূরি হরিদাস চট্টোপাধ্যায়। অত্যন্ত রাশভারী এই ভদ্রলোককে শরৎচন্দ্রও সমীহ করতেন। একবার শরৎচন্দ্র নিজের বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অসংখ্য ভুল দেখে মৃদুভাবে বলেছিলেন, ‘ও হরিদাস এটা তো আমার বই বলে মনেই হচ্ছে না!’  

আরও কত গল্প জড়িয়ে আছে এই প্রকাশনাকে ঘিরে। কান্তকবির ‘বাণী ও কল্যাণী’ বইয়ের প্রকাশক ছিল বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী। স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন, বইটির বিক্রি ছিল প্রচুর। মাত্র পঞ্চাশ টাকায় এই বইয়ের কপিরাইট কিনেছিলেন হরিদাস। ফলতঃ রজনীকান্ত রোগশয্যায় একটি টাকাও অর্থসাহায্য পাননি। প্রবোধকুমার সান্যাল তাঁর তিনটি গল্পের বই এবং 'প্রিয় বান্ধবী' উপন্যাসটির কপিরাইট দুশো টাকায় বিক্রি করেন। পরে চলচ্চিত্র হলে হরিদাসের কাছে টাকা চাইতে যান প্রবোধকুমার। একটি টাকাও পাননি তিনি। এমনকি, বিভিন্ন সময় যে সমস্ত লেখক দপ্তরে লেখা পাঠিয়েছেন এবং তা অমনোনীত হয়েছে, সেই লেখা ফেরত নিতে এসে হরিদাসের নিষ্ঠুর আচরণেরও মুখোমুখি হন অনেকে।  

হরিদাসের অনমনীয় ব্যবহারে বহু লেখক পরবর্তীতে সরে গেছিলেন এই সংস্থা থেকে। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় যে সম্মান ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন, তিলে তিলে তার অনেকটাই ধুলোয় মিশিয়েছিলেন হরিদাস।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে ব্যবসা মার খেতে থাকে প্রকাশনাটির। শেষের দিকে বই প্রকাশও কমে যায় অনেকটাই। তবু সাতের দশকেও টিকে ছিল এই সংস্থা। অবশ্য তখন বিক্রি প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। নতুন লেখকদের প্রায় কেউই ভিড়ছেন না এই প্রকাশনার দিকে। বছর তিরিশেক আগে একেবারে ঝাঁপ পড়ে প্রকাশনায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব একটা বড় কারণ ছিল। নতুন বই আর ব্যবসা দিতে পারছে না, পাশাপাশি দোকান ও প্রকাশনা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্যও ছিল না।

কিছুকাল আগেও ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’ লেখা একটা সাইনবোর্ড দেখা যেত। এখন তাও নেই। বর্তমান বংশধরেরা বিদেশে। উত্তর কলকাতার সিমলাপাড়ার সেই হলুদ বাড়িতে এখন ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া-র একটি শাখা। তবুও মুছে যাওয়া সেই স্বর্ণযুগকে আজও বাংলা প্রকাশনা জগত মনে রেখেছে। পুরনো দিনের প্রকাশনা সংস্থার বিষয়ে কথা উঠলে এখনও যে নাম পাঠকের মনে ভেসে ওঠে, তার অনেকটা জুড়েই রয়েছে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স।

Powered by Froala Editor