ষোড়শ শতাব্দীর একদম গোড়ার দিকের কথা। তখনও নবদ্বীপ ছেড়ে পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেননি চৈতন্য। কৃষ্ণের আরাধনায় বিভোর হয়ে কাটাচ্ছেন দিন। সঙ্গে বৈষ্ণব আন্দোলন তো রয়েইছে। অমন সময়, নবদ্বীপে এলেন আরেক সাধক। সেই সাধকেরও লীলা বড় কম নয়। ‘গুরু’র স্বীকৃতি পেয়েছেন আগেই। পূর্ব ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে নবদ্বীপে যখন উপস্থিত হলেন, চৈতন্যের সঙ্গে কি দেখা হয়েছিল তাঁর? স্পষ্ট কোনো প্রমাণ না থাকলেও, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি ঐতিহাসিকরা। কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তাঁদের? ধর্ম? না সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে? তা আজ আর জানার উপায় নেই। শুধু স্পষ্ট করে এটুকুই বলা যায়, যে-সময় নবদ্বীপে প্রবলভাবে বিরাজ করছেন চৈতন্য, ঠিক তখনই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক।
শুধু নবদ্বীপেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – সে-আমলের অখণ্ড বাংলার অনেক স্থানেই গিয়েছিলেন গুরু নানক, যা শুনলে অবাক লাগতে পারে আজ। হয়তো সে-আমলে কোনো কোনো জায়গার নাম আলাদা ছিল, পরবর্তীকালে এখনকার নাম পেয়েছে। কিন্তু তখনও যে জনপদগুলি বর্তমান ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গুরু নানকের এই ভ্রমণপথ খেয়াল করলেই।
বিহার হয়ে, ১৫০৪ সালে গুরু নানক প্রবেশ করেন বাংলায়। প্রথমেই যান রাজমহলে। সেখান থেকে, তাঁর পরবর্তী গন্তব্য মালদা। জনৈক ‘রামবাবু’র বাগানে তিনি কয়েকদিন কাটান। সেই বাগান আজ ‘গুরু কি বাগ’ নামে পরিচিত। মালদা থেকে, গঙ্গা পেরিয়ে মুর্শিদাবাদে এলেন নানক। তারপর নদীয়ায় প্রবেশ করেন তিনি। যান নবদ্বীপে। চৈতন্যের সঙ্গেও সাক্ষাৎও সম্ভবত তখনই। নবদ্বীপ থেকে কৃষ্ণনগর এবং সেখান থেকে বর্তমান বাংলাদেশে প্রবেশ করেন নানক। ফরিদপুর হয়ে পৌঁছোন ঢাকায়।
ঢাকায় বেশ কয়েকদিন কাটিয়ছিলেন নানক। সেখানকার বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের প্রধানদের সঙ্গে আলাপও হয় তাঁর। তাঁদের মধ্যে ছিলেন লুনিয়া সিদ্ধা, রেওয়া দাস, নারায়ণ দাস, চন্দন দাস, শেখ আহমেদ প্রমুখ। ঢাকায় থাকাকালীনই, তিনি রমনায় ঢাকেশ্বরী কালীমন্দিরে যান।
ঢাকা থেকে ধানপুর হয়ে ব্রহ্মপুত্রের তীর ধরে উত্তরদিকে এগোন নানক। মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ হয়ে আসামে প্রবেশ করেন তিনি। সিলেট ও করিমগঞ্জেও তাঁর উপস্থিতির কথা জানা যায়। আসামের পর, মণিপুর ও ত্রিপুরা হয়ে, চট্টগ্রামের পথ ধরে আবার বাংলায় প্রবেশ করেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, বাড়ব কুণ্ড ভ্রমণ করে, চাঁদপুর ও কেশবপুর হয়ে কলকাতায় হাজির হন তিনি।
তখন অবশ্য এই জনপদ পরিচিত ছিল না ‘কলকাতা’ নামে। আজকের কলকাতার সঙ্গে মেলাতে গেলে হতাশ হবেন। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল তখন গণ্ডগ্রাম। গুরু নানক কলকাতায় এসে রাজা ভাদর সিং-এর আতিথ্য গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে, ভাদর সিং-এর প্রপৌত্র রাজা হাজুরি সিং কলকাতার হ্যারিসন রোড (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড) সংলগ্ন এলাকায় তৈরি করেন ‘বড়ে সঙ্গত গুরুদ্বারা’। এটিই কলকাতার প্রথম ও সর্ববৃহৎ গুরুদ্বারা।
আরও পড়ুন
চৈতন্য এই ঘনকালো, হাত-পা কাটা জগন্নাথের বুকের ভিতরেই মিলিয়ে গিয়েছিলেন?
কলকাতা থেকে নানক হুগলি, চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় যান। বেশ কিছু অঞ্চল চিহ্নিত করা গেছে, যেখানে নানক উপস্থিত হয়েছিলেন। সেগুলির মধ্যে দমদম, বারাসাত, হাওড়া, শ্রীরামপুর, চন্দননগর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেদিনীপুরে, চন্দ্রকোণাতেও হাজির হয়েছিলেন তিনি। তারপর, মেদিনীপুরের পথে প্রবেশ করেন ওড়িশাতে।
বাংলার যেখানে-যেখানে নানক গিয়েছিলেন, প্রায় প্রত্যেক জায়গাতেই পরবর্তীকালে নানকের অনুগামীরা এসে বসবাস শুরু করেছেন, তৈরি করেছেন গুরুদ্বারা। অথচ নানকের বাংলা ভ্রমণের সম্পূর্ণ মানচিত্র নিয়ে বিশেষ আলোচনা দেখা যায় না কোথাও। তাঁর সঙ্গে বাংলার যোগসূত্র সত্যিই অবাক করার মতো। কত কী অজানা থেকে যায়...
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
চৈতন্যদেব নাম দিয়েছিলেন ‘নব-নীলাচল’, বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে শ্রীরামপুর