শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে বাগবাজার বাটার দিকে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াই। রাস্তার পাশেই গলি বেয়ে ঢুকে সারি সারি দোকান। দশকর্মা, মনিহারি কিংবা গ্রহরত্ন। চেনা উত্তর কলকাতাইয়া ছবি। গলির মুখটায় বড় দোকানঘর। ধূলি-ধুসরিত বয়ামে মিষ্টি মশলা। ছেঁচা পান। রুপোর তবক মোড়া কুচো সুপারি। তাকের উপর নানা আকারের শিশি বোতল। নানা রং ও গন্ধের তরলে ভরা। বোতলের গায়ে লেবেল। ‘তারক গুপ্তে’র... বাকিটা ঝাপসা। রংচটা সাইনবোর্ড। অনেক কষ্ট করে পড়তে হল। ‘গুপ্ত পারফিউমার্স, ১৯১৫’।
একশো বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান! অথচ এমন হেলায় পড়ে রয়েছে কেন?
ঘরে বিছিয়ে রাখা সাদা গদিতে ধুলোর আস্তরণ। সূর্য মধ্যগগনে। অথচ দোকানঘরে পৌঁছয় না আলো। সারি সারি বয়ামের মাঝে চোখ চালিয়ে নজরে পড়ল এক বৃদ্ধকে। ক্লান্তিতে মেলে গদির উপরে দিয়েছেন শরীর। ঈষৎ গলা খাঁকারিতে উঠে বসেন ভদ্রলোক।
‘আতর লাগবে?’
একটার পর একটা শিশি খুলে বৃদ্ধ রুমালে ঢালছেন তরল। গোলাপ, জুঁই, বেলফুল, চন্দন। গন্ধে ম-ম করে ওঠে দোকানঘর। প্রতি শিশি অর্থাৎ দশ গ্রাম আতরের দাম দু'শো টাকা। বয়াম থেকে খুব সাবধানে, নিউ-নর্মাল বিধিনিষেধ মেনেই হাতে তুলে দেন মিষ্টি পানের কুচি।
ভদ্রলোকের নাম রামপদ মাইতি। এই দোকানের একমাত্র কর্মচারী অথবা রক্ষক। ছাপান্ন বছর ধরে সামলাচ্ছেন গুপ্ত পারফিউমার্স।
আরও পড়ুন
মানুষের স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করবে কৃত্রিম শব্দ ও গন্ধ, অবাক করা আবিষ্কার এমআইটির
‘...চার-পুরুষের দোকান। আমিই তো আছি তিন পুরুষ ধরে। তখন দোকানে ভিড় লেগেই থাকত। কত ফিল্মস্টার, নেতা এসে আতর নিয়ে যেতেন… সন্ধে ছ'টা থেকে লাইন পড়ত মিষ্টি মশলার জন্য। সেই লাইন পাঁচমাথার মোড় ছাড়িয়ে যেত বুঝলেন... সেসব এক দিন ছিল…’
কিশোর বয়সে গ্রাম থেকে আত্মীয়ের হাত ধরে রামপদবাবু চলে এসেছিলেন কলকাতা। আর ফেরেননি। এখন মালিকের বাড়িতেই থাকেন। তৃতীয় পুরুষের আমল থেকেই লোকসানের মুখ দেখতে শুরু করে ব্যবসা। বাজার কাঁপিয়ে চলে আসে নানা ব্র্যান্ডের সেন্ট আর ডিওডেরান্ট। বিদেশি ল্যাভেন্ডার ঢেকে দিচ্ছে স্বদেশি বেলফুলের গন্ধ।
আরও পড়ুন
গন্ধ থেকেই ছড়ায় মহামারী, চিনা তান্ত্রিকদের তত্ত্ব জনপ্রিয়তা পেল ইউরোপেও
‘মাসে দু'শো টাকার বিক্রি। কখনো কখনো হয় না। লকডাউনে বন্ধ ছিল প্রায় মাস চারেক। দোকানের ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা...কীভাবে চলছে জানি না…’
‘আপনার রোজগার হয় কীভাবে?’
আরও পড়ুন
গন্ধ শুঁকেই বুঝতে পারে উষ্ণতা, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী কুকুররা
বৃদ্ধ হাসেন। চোখে চাপা বিষণ্নতা নিয়ে। উত্তর কলকাতার অলিগলিতে এমন মানুষ হয়তো খুঁজলে মিলবে এখনো। ছেড়ে যেতে পারেন না যাঁরা। বছরের পর বছর দোকানঘর আঁকড়ে থাকেন মায়ায়। পরম মমতায় হাত বোলান বয়ামের গায়ে। গোলাপ, রজনীগন্ধা, জুঁই বেলফুল…
বেরিয়ে আসি একসময়। রুমালে মিশে থাকে একঝলক পুরোনো কলকাতা…
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: রামপদ মাইতি, গুপ্ত পারফিউমার্স।
Powered by Froala Editor