তিনি নিজেকে বাঙালি-ই বলেন। মননে। চেতনায়। বাই চান্স জন্ম এক পাঞ্জাবি পরিবারে। কিন্তু বাই চয়েস তিনি বাঙালি। এমনটাই ভাবতে ভালোবাসেন যে মানুষটি, তিনি গুলজার। শুধু ভাবতে পছন্দ করা নয়, তাঁর যৌবনে বম্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন যে বাঙালি শিল্পীরা, তাঁদের কাছে যেন বাঙালিয়ানার দীক্ষাই নিয়েছিলেন তিনি। আর কী আশ্চর্য, সেই গুলজারের বাড়ি কেনার টাকাও দিয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তানই। সে-এক অনাস্বাদিত সৌজন্যের ইতিহাস।
বিমল রায় তখন প্রয়াত হয়েছেন। গুলজারের ভাষায়, তাঁর সন্তানরা তখন অনাথ। সন্তান বলতে, গুলজার ও আরো অনেকে। যাঁরা বিমল রায়ের কাছেই কাজ শিখেছেন, তাঁর কাছেই কাজ করতেন। তাঁর প্রয়াণ তাই ইন্দ্রপতন। আক্ষরিক অর্থেই যেন ইন্ডাস্ট্রির স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। কিন্তু এক বাঙালির ফেলে যাওয়া কাজ যেন হাতে তুলে নিলেন আর-একজন। তিনি হেমন্ত কুমার। আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বম্বেয় দাপিয়ে কাজ করছেন। সুরকার, গায়ক তো বটেই, ছবি প্রযোজনা করাও শুরু করেছেন। ধুতি-শার্ট পরেই মার্সিডিজ চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গোটা বম্বে। আমরা আঁচ করতে পারি, বাঙালিয়ানার সেই আভিজাত্য। খুব বেশি সময় লাগল না, মোহাবিষ্ট হলেন গুলজারও।
হেমন্ত কুমার ডেকে নিলেন গুলজারকে। যেমন বিমল রায়ের ইউনিটের প্রায় প্রত্যেকের কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। গুলজারকে তিনি তাঁর সঙ্গী করে নিলেন। দীপ জ্বেলে যাই-কে হিন্দিতে করার পরিকল্পনা তখন তাঁর মাথায় ঘুরছে। পরিচালক অসিত সেনের সঙ্গে কথা বলে সব পাকা হল। প্রথমদিন ওয়াহিদা রেহমানকে দেখেই অসাধারণ এক পঙক্তি মাথায় এসেছিল গুলজারের। পরে, তা নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিল। গুলজারের লেখা গান না কবিতা - সে প্রশ্ন উঠেছিল। হেমন্তবাবু অবশ্য সাফ জানিয়েছিলেন, নিজের লেখা থেকে যেন না সরেন গুলজার। কিংবদন্তি গীতিকার তাঁর 'পান্তাভাতে' বইটিতে জানান, ওই সাহস সেদিন হেমন্তবাবু জুগিয়েছিলেন বলেই হয়তো 'গুলজারিশ' কথাটা চালু হয়েছে। আমরা বুঁদ হয়েছি যে গুলজারিশে।
শুধু সাহস নয়, গুলজারের মাথার উপর ছাদের বন্দোবস্ত করতেও এগিয়ে এলেন সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই। সুরকার নচিকেতা ঘোষ সে সময় তাঁর বম্বের বাড়ি বিক্রি করবেন মনস্থ করেছেন। গুলজার জানতেন সে-কথা। কিন্তু কিনবেন যে, অর্থ কোথায়! একদিন স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই গুলজারকে সে-কথা জিজ্ঞেস করলেন। গুলজার জানালেন, ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জলদগম্ভীর স্বরে এল নির্দেশ - গুলজার যেন নচিকেতা ঘোষের বাড়ি গিয়ে সইসাবুদ করে আসেন। ডাউন পেমেন্ট তিনিই করে রেখেছেন। গুলজার তো শুনে থ। হেমন্তবাবু তখন হেসে বললেন, চিন্তা নেই। গুলজারের বেতন থেকে তিনি টাকা কেটে নেবেন। অর্থাৎ, চাকরিও পাকা। মাথার উপর ছাদও হল। সেই প্রথম পিজি থেকে নিজের ঘর হল গুলজারের।
আর সে-ঘরে বসত এক ঐশ্বরিক আড্ডা। হারমোনিয়াম টেনে গান ধরেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। পাশেই বসে তরুণ মজুমদার। ওদিকে চায়ের জল চাপিয়েছেন গুলজার। হঠাৎ গাইতে গাইতে গাইতে একটা লাইন ভুলে গেলেন হেমন্তবাবু। আর সঙ্গে সঙ্গে গীতবিতান নামিয়ে সে-গান খুঁজে দিলেন গুলজার। এবার চমকের পালা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। গুলজার এত ভালো বাংলা পড়তে জানেন!
হ্যাঁ তিনি জানেন। বাংলাকে ভালোবাসতে। বাই চয়েস বাঙালি হয়ে উঠতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা বলতে গিয়ে তাই তিনি বলেন, ' সবার হৃদয় এত বড়ো হয় না, বাঙালিদের হয়'। আমরা বুঝতে পারি, আসলে যেন তিনি বলছেন, হৃদয়ের প্রসারতাই কাউকে বাঙালি করে তোলে। যে ভাবে বাঙালি স্বয়ং গুলজার।