ঘরের একটি দেয়ালজুড়ে সাজানো অসংখ্য পুরস্কার আর স্মারক। তার মধ্যে রয়েছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের (Guinness Book of World Record) সার্টিফিকেটও। সকাল হলে সেই মানুষটাই এখন বেরিয়ে পড়েন কারখানার উদ্দেশে। সারাদিন কাঠ কাটার পর যখন সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহে ঘরে ফেরেন, প্রিয় বাঁশিটায় ফুঁ দেওয়ার মতো ক্ষমতা তখন আর থাকে না। এই করোনা পরিস্থিতি যেন ভুলিয়ে দিয়েছে, তিনি আসলে একজন শিল্পী। এখন সামান্য কিছু উপার্জনের জন্য লড়াই করছেন কেরালার বাঁশিবাদক মুরলী নারায়ণন (Murali Narayanan)।
ছোটো থেকে একমাত্র বাঁশি বাজানোই ভালো লাগে মুরলীর। তাঁর সেই ভালোলাগার সঙ্গে মিলিয়েই বাবা-মা নাম রেখেছিলেন মুরলী। ত্রিশূর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পড়াশোনা নিয়ে তেমন চাপ ছিল না কোনোদিনই। তাই সবটুকু সাধনা ঢেলে দিতে পেরেছিলেন ভালোবাসার কাছে। বাঁশিতে নানারকম সুর তো শিখলেন মুরলী। তবে তার থেকেও যে বিষয়টা সবাইকে অবাক করল তা হল, একবারও বিরতি না নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাজিয়ে যেতে পারেন তিনি। এমনকি ঠোঁট থেকে বাঁশি সরিয়ে সামান্য নিঃশ্বাস নেওয়ারও প্রয়োজন হয় না। বাঁশি বাজাতে কী পরিমাণ দম লাগে, তা সবাই জানেন। আর সেখানেই মুরলীর অদ্ভুত ক্ষমতা।
মুরলী জানতেন না যে এই প্রতিভার এক বিরাট পুরস্কার অপেক্ষা করে রয়েছে। এর মধ্যেই একদিন সংবাদপত্রে পড়লেন, লন্ডনের এক ব্যক্তি একটানা ২৭ ঘণ্টা ১০ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড বাঁশি বাজিয়ে গিনেস বুকে নাম তুলেছেন। চাইলে তিনিও কি এতক্ষণ বাঁশি বাজাতে পারবেন না? অবশ্য এর আগে কেউ তাঁকে একটানা অতক্ষণ বাঁশি বাজাতে দেয়নি। কিন্তু ১০-১২ ঘণ্টা বাজিয়েছেন প্রায়ই। এই খবর পড়ার পরেই জেদ চাপল মুরলীর মাথায়। রাতদিন এক করে শুরু করলেন অনুশীলন। কিন্তু শুধু এটুকু করলেই তো হবে না। তাঁর এই পারার কথা তো জানাতে হবে গিনেস বুকের কর্তাদের। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখবেন। তার জন্য বিদেশেও যেতে হতে পারে। সেসব তো অনেক খরচের ব্যাপার।
নানা জায়গা থেকে ধার-দেনা করে শেষ পর্যন্ত লন্ডনে গেলেন মুরলী। ২০১৬ সালে একটানা ২৭ ঘণ্টা ২০ মিনিট ৫০ সেকেন্ড বাঁশি বাজিয়ে ভাঙলেন লন্ডনের ক্যাথেরিনের রেকর্ড। ইউরোপজুড়ে তখন হইচই পড়ে গিয়েছিল তাঁকে নিয়ে। নানা দেশ ঘুরতে হল তাঁকে। তারপর আবারও ফিরে এসে যোগ দিলেন স্থানীয় যাত্রার দলে। এই যে লন্ডন যাত্রার জন্য এত অর্থ ধার করেছেন, তা শোধ করতে হবে তো। যাত্রার দলের পাশাপাশি কেরালাতেও তাঁর একক বেশ কিছু শো হল এবার। ত্রিশূর শহরেই ২০১৯ সালে একবার একটানা ১০৮ ঘণ্টা বাঁশি বাজিয়েছেন তিনি। মাঝে কেবল ১ ঘণ্টা পরপর একবার করে বাঁশি সরিয়েছেন ঠোঁট থেকে। তবে গিনেস বুক থেকে ততদিনে তাঁর নাম আবার সরে গিয়েছে। ক্যাথেরিন আবার ২৭ ঘণ্টা ৩০ মিনিট বাঁশি বাজিয়ে নতুন করে নাম তুলেছেন। মুরলীও আবার চেষ্টা করলে সেই রেকর্ড ভাঙতে পারেন হয়তো। কিন্তু আগের দেনাই যে এখনও শোধ হয়নি।
আরও পড়ুন
হাত দিয়ে হেঁটে গিনেস রেকর্ড মার্কিন অ্যাথলিটের
এর মধ্যেই এসে পড়ল করোনা অতিমারী। বাড়ির রোজগারের একমাত্র উৎস তিনি। আর তাছাড়া দেনা শোধ করারও বিষয় রয়েছে। শেষ পর্যন্ত যাত্রাদলের কাজ বন্ধ হওয়ায় কাঠমিস্ত্রির কাজই বেছে নিতে হল তাঁকে। ধীরে ধীরে করোনাবিধি শিথিল হয়ে আসছে। অনেকেই আবার কাজে ফিরছেন। কিন্তু জনসমাগম যে এখনও বন্ধ। আর তাই মুরলীর মতো শিল্পীদের কাজে ফেরার উপায় নেই। এই অতিমারীর শেষে হয়তো এমন অনেকেই ভুলে যাবেন, তাঁরা কোনোদিন শিল্পী ছিলেন।
আরও পড়ুন
বিশ্বের কনিষ্ঠতম প্রোগ্রামার, ৬ বছর বয়সেই গিনেস বুকে আমেদাবাদের খুদে
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বয়স ১০০, বিশ্বের প্রবীণতম ভারোত্তলক হিসেবে গিনেস বুকে এডিথ