খাবার বিতরণের সঙ্গে অসহায় মানুষদের চিকিৎসাও, অনন্য নজির নদীয়ার রুটি ব্যাংকের

স্কুটার বা মোটরবাইক নিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ৯ জন যুবক। প্রত্যেকেরই দুচাকার সামনে লেখা, 'রুটি ব্যাংক'। হঠাৎ মনে হতে পারে, এই রুটি ব্যাংক আসলে কী? উত্তর দিলেন রুটি ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা তাপস কুমার মন্ডল। "ব্যাংকে যেমন টাকা রাখলে আবার প্রয়োজন মতো তুলে নেওয়া যায়, আমরা তেমনই রুটি সঞ্চয় করি। অবশ্য বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে রুটি সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে আমরা তুলে দিই অভুক্ত মানুষদের হাতে। তাই আমাদের কাজটাও তো অনেকটা ব্যাংকের মতোই।" দুর্গত ও অসহায় মানুষদের মুখে খাবার তুলে দিতে অবশ্য ফুড ব্যাংক বা মিলিত ভাঁড়ারের উদ্যোগ নতুন নয়। এই লকডাউনের সময় তেমনই নদিয়ার বগুলার ফুটপাথবাসীদের খিদের জ্বালা বুঝতে দেয়নি এই রুটি ব্যাংক।

একজন মধ্যবিত্তের বাড়িতে প্রতিদিন মাথাপিছু বরাদ্দ মোটামুটি চারটে করে রুটি। অথচ একটা কম খেলে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। এভাবে একটি পরিবার থেকেই জুটে যেতে পারে একজন অভুক্ত মানুষের খাবার। "ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমাদের মায়েদের বলি সে-কথা। তাঁরাও হাসিমুখে রাজি হয়ে যান।" এভাবেই শুরু রুটি ব্যাংকের পথচলা, জানালেন তাপস মন্ডল। ৩০ মার্চ থেকে প্রথমে একজন ভবঘুরে মানুষের খাবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু ৯ যুবকের। তারপর গ্রামের অন্যান্য মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে চলা। ১৬ এপ্রিল থেকে সামাজিক মাধ্যমকে কাজে লাগাতে শুরু করে রুটি ব্যাংক। আর এখন হাসপাতালের ধারে, স্টেশন চত্বরে অথবা বাজারের এক পাশে আশ্রয় নেওয়া অন্তত ৫০ জন অসহায় মানুষের মুখে নিয়মিত খাবার তুলে দিচ্ছেন তাঁরা। প্রথমে শুধু রুটি দিয়ে শুরু হলেও এখন অনেকের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করছেন অন্যান্য রান্না করা খাবারও।
 

শুধুই যে খাবার, তাও নয়। রুটি ব্যাংকের উদ্যোগ বেশ বিচিত্র। প্রয়োজনমতো অভাবী সংসারে তারা পৌঁছে দিচ্ছে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বা কারোর কারোর জন্য পড়ার বই। এই বেহাল অর্থনীতির মুখে মানুষের পাশে যতটুকু দাঁড়ানো যায় আরকি। গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁরা পৌঁছে গিয়েছেন আমফান বিধ্বস্ত সুন্দরবনেও। ২৭ ও ২৮ মে তাঁরা ত্রাণ সরবরাহ করেছেন বকখালি, নামখানা ও কাকদ্বীপ অঞ্চলে। ১ জুন পৌঁছে গিয়েছেন হাসনাবাদে। এভাবেই এই বিপন্ন সময়ে মানবিকতার ছবি তুলে ধরছেন তাপস, প্রসেনজিৎ, অরুণ, সুধাংশুরা। 

এর মধ্যে ১০ জুন তাদের আরেক মানবিক উদ্যোগের সাক্ষী থাকল বগুলা। কোনো দুর্ঘটনায় কিছুদিন আগে মাথায় আঘাত লাগে এলাকার এক ভবঘুরে মানুষের। তার মধ্যে রাস্তার ধুলো ও ময়লায় ঘা ক্রমশ বিষিয়ে উঠতে থাকে। অথচ বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে জানানোর পরেও কেউ তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি। অবশেষে এগিয়ে এলেন রুটি ব্যাংকের উদ্যোক্তারাই। সেই আহত মানুষটিকে পরিষ্কার করে, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিয়ে নিয়ে যায় স্থানীয় হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার জানান, তাঁকে রোজ হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে ড্রেসিং-এর জন্য। এই দায়িত্বটাও হাসিমুখে কাঁধে তুলে নেন ৯ যুবক। এই ঘটনার পরপরই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রহর। আর এমন একটা কাজ করতে পেরে আনন্দ আটকে রাখতে পারেননি তাপস মন্ডল নিজেও। জানিয়েছেন, "আগামী দিনেও এভাবেই মানুষের পাশে থাকবে রুটি ব্যাংক"।

আরও পড়ুন
আমফান-বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গ, বাঙালি বন্ধুর কাছে সাহায্য পাঠালেন আমেরিকার দুই নার্স

ওঁরা কেউ প্রাইভেট টিউশন পড়ান, কেউ আছেন চাকরির সন্ধানে। কারোর আছে ছোটোখাটো ব্যবসা। অর্থনৈতিক অবস্থা কারোরই খুব উন্নত নয়। কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানবিকতাটুকু আছে পুরো মাত্রায়। নিজেদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তাই সকলেই উত্তর দেন, "আমরা রুটি ব্যাংকের কর্মী।"

আরও পড়ুন
আমফানের তাণ্ডবও আঁচড় কাটতে পারেনি শতাব্দীপ্রাচীন টালা ট্যাঙ্কের গায়ে

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
আমফানে বিধ্বস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ালেন মোহনবাগানের গোলকিপার শিল্টন পাল