গ্রেমলিন— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যান্ত্রিক গোলযোগ বাঁধিয়েই খুশি হত যে-প্রাণী

আগেরদিনও দিব্যি আকাশে উড়েছে বিমান। অবতরণের পর সমস্ত যন্ত্রাংশ পরীক্ষাও করা হয়েছিল ভালো করে। তেল ভরা হয়েছিল বিমানের ট্যাঙ্কে। অথচ, সকাল হতে না হতেই শুরু ব্যারাম। বার বার ‘স্টার্ট’ দিলেও ঘর ঘর শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায় বিমানের ইঞ্জিন। ব্যাপার কী?

বিজ্ঞানের সঙ্গে যাঁদের ন্যূনতম সম্পর্ক রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই শর্ট-সার্কিটের কথা মাথায় আসবে তাঁদের। তবে যদি বলা যায়, এই বিশেষ সমস্যার জন্য দায়ী এক আশ্চর্য অদৃশ্য প্রাণী? মানুষের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে স্রেফ মজা নেওয়ার জন্যই নাকি এই যান্ত্রিক গোলযোগ বাঁধিয়েছে সে! শুনতে খানিকটা অবাস্তব শোনালেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমনই এক আশ্চর্য প্রাণীর তাণ্ডবের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল মুখে মুখে। 

গ্রেমলিন (Gremlins)। হ্যাঁ, বিশেষ প্রাণীটিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার বার বাধা দিত মানুষের কাজে। খারাপ করে দিত যন্ত্রাংশ। কখনও অকেজ করে দিত বিমানকে। কখনও আবার তাদের তাণ্ডবে চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যেত মেশিনগান, যুদ্ধাস্ত্র। অবশ্য গ্রেমলিনকে প্রাণী বললে ভুল হবে খানিক। বলতে গেলে, গ্রেমলিন জীববিজ্ঞানে আলোচিত প্রাণীদের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। বরং তাঁকে রাখা যায় অলৌকিকতার গ্রন্থে, দত্যি-দানোর অধ্যায়ে।

বাংলা সাহিত্যে যেমন ভূত-প্রেত-পিশাচের ছড়াছড়ি, তেমনই কম যায় না ইউরোপীয় সাহিত্যও। উইচ, ঘোস্ট, ড্রাকুলা-সহ হরেক কিসিমের অলৌকিক জীবের অস্তিত্ব রয়েছে সেখানেও। তাছাড়াও পাশ্চাত্য সাহিত্যে রয়েছে নানান মাইথোলজিক্যাল অর্থাৎ পৌরাণিক প্রাণীদের বর্ণনা। আর এইসব অলৌকিক তথা অতিলৌকিক প্রাণীদের মধ্যে কনিষ্ঠতম হল গ্রেমলিন। যার জন্ম বিশ শতকে। 

১৯২৯ সাল সেটা। মধ্যপ্রাচ্যের উপনিবেশ মালটায় কর্মরত ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পাইলটরা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন, এই আশ্চর্য প্রাণীর তাণ্ডবের কথা। এমনকি এর কিছুদিনের মধ্যেই মালটার স্থানীয় পত্রিকা ‘এরোপ্লেন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল গ্রেমলিনদের নিয়ে আস্ত একটি গল্প এবং কবিতা। সেই শুরু। তারপর ধীরে ধীরে গ্রেমলিনদের তাণ্ডব শুরু হয় বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও। 

অবশ্য গবেষকদের একাংশের দাবি, গ্রেমলিনদের জন্ম হয়েছিল আদতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই গ্রেমলিনরা নাকি তাণ্ডব শুরু করেছিল মার্কিন মুলুকে। তারপর ধীরে ধীরে সেই কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ পাইলট ও সেনাদের মধ্যেও। যদিও ১৯২৯ সালের আগে কোনো সংবাদপত্র, গ্রন্থ বা পত্রিকায় ছাপার হরফে গ্রেমলিনদের কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্য যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র— এই দুই রাষ্ট্রই যে জড়িয়ে গ্রেমলিন কিংবদন্তির সূত্রপাতের সঙ্গে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তার কারণ খোদ ‘গ্রেমলিন’ নামটি। 

প্রাচীন ইংরাজি শব্দ ‘গ্রেমিয়ান’ থেকে উৎপত্তি হয় ‘গ্রেমলিন’ শব্দটির। যার অর্থাৎ ‘বিক্ষোভ করা’ বা ‘বাধা দেওয়া’। আশ্চর্য এই পৌরাণিক প্রাণী মানুষের তৈরি প্রযুক্তি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করত বলেই, এমন নাম। ফলে, এই মিথ অন্য কোনো দেশের আঞ্চলিক সাহিত্য থেকে ধার করা নয় একেবারেই। বরং, ইংরাজির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তার শিকড়। 

যাই হোক, বিশ শতকের তিরিশের দশকের শুরু থেকেই ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য সাহিত্যে জোরদার হতে শুরু করে গ্রেমলিনদের অস্তিত্বের কথা। আশ্চর্যের বিষয় হল, গ্রেমলিন সংক্রান্ত প্রতিটি গল্প-উপন্যাসেই ব্যবহৃত হত প্রায় একইরকম চারিত্রিক বর্ণনা। তারা নাকি আকারে খুব ছোটো। তবে দেহের তুলনায় কান অস্বাভাবিকরকম লম্বা। সাধারণ মানুষের চোখে দৃশ্যমানও নয় তারা। তবে তাদের খিনখিনে গলা, অট্টহাসি শোনা যায় কখনো কখনো। 

প্রাথমিকভাবে পাশ্চাত্য সাহিত্যে গ্রেমলিনদের গল্প রমরমিয়ে চললেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সৈনিকদের মনে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল এই ক্ষুদ্রতম ও কনিষ্ঠতম দানব। বিশেষ করে ব্রিটিশ এয়ারফোর্স এবং সেনাবাহিনীর বহু সৈনিকই বেঁকে বসেছিল যুদ্ধে যাওয়া বা বিমান চালানোর জন্য। বলতে গেলে গ্রেমলিনরা হয়ে উঠেছিল একটি অজুহাত। শক্তিশালী জার্মান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে না-লড়তে যাওয়ার ছল। আবার গ্রেমলিন ঘাড়ে বন্দুক চালিয়ে দোষমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছিল সে-যুগের প্রযুক্তিবিদরাও। 

পারতপক্ষে সে-সময় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দ্রুত যুদ্ধযান ও যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করার কারণেই ভুলত্রুটি থেকে যেত অনেকক্ষেত্রেই। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসে গ্রেমলিনের উপকথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমস্ত যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধযানের অহরহ পরীক্ষা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের পর প্রাধান্য হারায় গ্রেমলিনরা। তবে আজও ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড বা ফ্রান্সের প্রান্তিক অঞ্চলে গেলে শোনা যাবে গ্রেমলিনদের কাহিনি। হাত থেকে কোনো যন্ত্র অকস্মাৎ পড়ে গেলেই বা কোনো বৈদ্যুতিন যন্ত্র খারাপ হয়ে গেলে নিজের অজান্তেই কেউ কেউ বলে ওঠেন ‘গো গ্রেমলিন, স্টে অ্যাওয়ে’। বলতে গেলে এভাবেই আজ বেঁচে আছে গ্রেমলিনরা। বেঁচে আছে কিছু কল্পবিজ্ঞানের সিনেমা-উপন্যাস-গল্পের মাধ্যমেও। এমনকি অদ্রীশ বর্ধনের হাত ধরে বাংলাতেও রীতিমতো বিরাজমান এই খুদে, আমুদে শয়তানরা…

Powered by Froala Editor