‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’, এখন পৃথিবীর অবিচ্ছেদ্য অংশ!

সমুদ্রজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মাছ ধরার জাল, প্লাস্টিকের বোতল, টায়ার, টুথব্রাশ, পলিব্যাগ-সহ অসংখ্য আবর্জনা। বলতে গেলে আবর্জনার এই স্তূপ যেন পরিণত হয়েছে ভাসমান একটি দ্বীপে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া এবং হাওয়াইয়ের মধ্যবর্তী প্রশান্ত মহসাগরে ভেসে বেড়ানো এই প্রকাণ্ড আবর্জনা-দ্বীপের আয়তন প্রায় ৬২০০০০ বর্গ মাইল। প্রশান্ত মহাসাগরে ভাসমান এই বৃহত্তম আবর্জনার স্তূপ আমাদের কাছে পরিচিত ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’ (Great Pacific Garbage Patch) নামে। এই আবর্জনার স্তূপ যে ভয়াবহ দূষণ ছড়িয়ে চলেছে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই স্তূপই ধীরে ধীড়ে হয়ে উঠছে বাস্তুতন্ত্রের আধার। 

হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। এই ভাসমান আবর্জনার স্তূপেই এবার ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছে সামুদ্রিক প্রাণীরা। এবার এমনই আশ্চর্য তথ্য প্রকাশ্যে আনল সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র। 

কয়েক বছর আগের কথা। ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’-এ কতটা দূষণ ছড়াচ্ছে সামুদ্রিক পরিবেশে, সামুদ্রিক খাদ্যের মাধ্যমে তার কতটা প্রভাব পড়ছে মানব সভ্যতায়— সে-ব্যাপারে গবেষণা শুরু করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারের গবেষক লিনসে হারাম। সেই সমীক্ষা করতে গিয়েই তিনি চিহ্নিত করেছিলেন এই আবর্জনার স্তূপ ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে আস্ত একটি বাস্তুতন্ত্রে। 

কচ্ছপ, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ তো বটেই, সেইসঙ্গে এই আবর্জনার স্তূপ বিশেষভাবে বাসস্থান হয়ে উঠেছে সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের। সেই তালিকায় রয়েছে কাঁকড়া, চিংড়ি, জেলিফিশ, বুডিব্রাঞ্চ, ব্লু ড্রাগন, সি-হর্স, নিউস্টন-সহ একাধিক বিরল সামুদ্রিক প্রাণী। সাধারণত, এইসব সামুদ্রিক প্রজাতিদের একটা বড়ো অংশ প্রজননের সময় অভিবাসন করে উপকূলের দিকে। আবার বহু উপকূলীয় প্রজাতিও প্রজননের জন্য এসে হাজির হয় মাঝ-সমুদ্রে। দুটি ক্ষেত্রেই বর্তমানে এই ভাসমান দ্বীপ হয়ে উঠেছে প্রজননক্ষেত্র।  

সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে সমুদ্রস্রোত এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের ওপর ভিত্তি করে পাঁচ ভাগে ভাগ করে থাকেন গবেষকরা। প্রতিটি বিভাগেই দেখা মেলে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীদের। মজার বিষয় হল, এই পৃথক পৃথক পাঁচটি বাস্তুতন্ত্রেরই সন্ধান মিলেছে গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচে। অর্থাৎ, আক্ষরিক অর্থেই ফাইভ গিয়ার ইকোসিস্টেমে পরিণত হয়েছে এই আবর্জনার স্তূপ। 

বলার অপেক্ষা থাকে না, আবর্জনার স্তূপের ওপর গজিয়ে ওঠা এই বাস্তুতন্ত্র আরও বড়ো চ্যালেঞ্জ হাজির করেছে গবেষকদের সামনে। বিগত কয়েক দশক ধরেই গবেষকরা চেষ্টা করে চলেছেন ধীরে ধীরে জমে থাকা এই বর্জ্য অপসারণের। বর্তমানে এই প্রকল্পে যোগ দিয়েছে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়। কিন্তু গবেষকদের এই প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত হয়ে উঠতে পারে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রেই। প্লাস্টিক অপসারণের প্রক্রিয়া বহু বিপন্ন প্রজাতিকে ঠেলে দিতে পারে সম্পূর্ণ অবলুপ্তির দিকে। কাজেই মেনে নিতে হবে পৃথিবীর একটি স্থায়ী অংশে পরিণত হয়েছে এই স্তূপ। 

না, এখনও পর্যন্ত কোনো সমাধানের হদিশ দিতে পারেননি গবেষকরা। তবে ডঃ হারামের অভিমত, বর্তমানে গোটা বিশ্বের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত যে-কোনো প্রকারে এই ভাসমান আবর্জনার দ্বীপের বৃদ্ধি আটকানো। প্লাস্টিক বর্জ্য যেন কোনোভাবেই সমুদ্রে না মেশে— তার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার আর্জিও জানাচ্ছেন তিনি। তার কারণ, ঘূর্ণায়মান সমুদ্রস্রোতের মাধ্যমে যে-কোনো সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্যই এসে জমা হয় প্রশান্ত মহাসাগরের এই বিশেষ অংশে। বাড়তে থাকে আবর্জনার দ্বীপের আকার। ফলে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ২০৬০ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন গুণ হয়ে দাঁড়াবে এই স্তূপের আকার। কোনোভাবেই প্রতিহত করা যাবে না দূষণকে। 

Powered by Froala Editor