আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে দক্ষিণতম ভূখণ্ড গ্রেট নিকোবর দ্বীপ (Great Nicobar Island)। সেখানেই গড়ে উঠতে চলেছে এক নয়া ‘সভ্যতা’। আগামী এক দশকের মধ্যেই সেখানে তৈরি হবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ট্রান্স-শিপমেন্ট পোর্ট, বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, টাউনশিপ এবং পর্যটনকেন্দ্র। সবমিলিয়ে ৭২ হাজার কোটি টাকার এই মেগা-প্রোজেক্ট (Great Nicobar Project) রীতিমতো হুলিয়া বদলে দেবে ভারতের দক্ষিণতম দ্বীপটির। তবে তার জন্য ভালোরকম খেসারতও দিতে হবে প্রকৃতিকে। তা নিয়েই সরব হয়েছিলেন পরিবেশবিদরা। এবার উঠে এল আরও একটি আঙ্গিক। এই প্রকল্পের জন্য বিপন্ন হবেন সহস্রাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ।
সম্প্রতি এমনটাই জানাল আইআইটি বোম্বের (IIT Bombay) ‘সেন্টার ফর টেকনোলজি অল্টারনেটিভস ফর রুরাল এরিয়া’-র অধ্যাপক ডঃ পঙ্কজ শেখসরিয়ার গবেষণা। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন বোম্বে আইআইটির অধ্যাপক। এ-বিষয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থও রয়েছে তাঁর।
চলতি মাসের শুরুতে পরিবেশমন্ত্রক এবং তফসিলি অধিকার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের থেকে পাকাপাকিভাবে গ্রেট নিকোবর প্রোজেক্ট ক্লিনচিট পাওয়ার পর, সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ডঃ শেখসরিয়া। সেখানেই উঠে আসে একের পর এক অসঙ্গতি।
প্রথমত গ্রেট নিকোবরে সবমিলিয়ে বর্তমানে বসবাস মাত্র ৮০০০ মানুষের। যার মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষ। এই তালিকায় রয়েছে মূলত দুটি উপজাতি— শম্পেন ও নিকোবরিজ। শম্পেনদের সংখ্যা মাত্র ২০০-র কাছাকাছি। অন্যদিকে নিকোবরিজদের সংখ্যা ১০০০। উল্লেখ্য, এই দুই জনগোষ্ঠীকে ‘ভালনারেবল’ বা বিপন্নপ্রায় জনগোষ্ঠীর তকমা দিয়েছিল খোদ ভারত সরকার-ই। তবে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের লাভের হিসেব করতে গিয়ে বাদ পড়ে গেছে তাঁদের অধিকারের কথাই। এমনকি সরকারি নথিতে এক এক জায়গায় এক এক বানানে লেখা হয়েছে এইসকল জনগোষ্ঠীর নাম!
মুম্বাই-এর গবেষকের কথায়, ১৯৬০-এর দশকে গ্রেট নিকোবরে জনবসতি ছিল মাত্র এক হাজার। অর্থাৎ সে-সময় থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁদের জনসংখ্যার উন্নতি হয়নি সেভাবে। এমত অবস্থায় হঠাৎ করে গোটা দ্বীপের চেহারা বদলে গেলে, বদলে যাবে তাঁদের স্বাভাবিক জীবনও। এই দুই জনগোষ্ঠীই প্রাক-কৃষিজ সময়ের জীবনযাপনে অভ্যস্ত। অর্থাৎ, সম্পূর্ণভাবেই তাঁদের জীবন নির্ভরশীল অরণ্য এবং প্রকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের উপরে।
গ্রেট নিকোবর প্রকল্পের জন্য সবমিলিয়ে কাটা পড়বে ১৩০ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য। যার মধ্যে রয়েছে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত অরণ্যের একাংশ। ৮৪ বর্গকিলোমিটার অরণ্য নিধন নিয়ে কোনোরকম আলোচনাই করা হয়নি সরকারি রিপোর্টে। একদিকে যেমন এই অরণ্য নিধনের কারণে বনজ সম্পদের সংকট দেখা দেবে আদিবাসীদের মধ্যে, তেমনই বিস্তীর্ণ যে অঞ্চল এতদিন বাফার জোন হিসাবে কাজ করত তাঁদের ও ‘সভ্য’ মানুষের মধ্যে— উধাও হয়ে যাবে সেটাও। ফলে, সহজেই সংঘাত শুরু হবে সংস্কৃতির। প্রাচীন সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র ভাষাও হারাতে পারেন এই মানুষরা, আশঙ্কা করছেন মুম্বাই-এর গবেষক। সরকারের লক্ষ্য, আগামী তিন দশকের মধ্যে এই দ্বীপে ৩.৫ লক্ষ মানুষের বাসস্থান গড়ে তোলা। তেমনটা হলে এক ধাক্কায় ৪০০০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এই দ্বীপের জনসংখ্যা। তাতে মিসেলস কিংবা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে প্রাচীন জনগোষ্ঠীদের মধ্যে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনকালে। উজাড় হয়ে গিয়েছিল একের পর এক আন্দামান-নিকোবরের দ্বীপগুলি।
বিগত কয়েক সপ্তাহের গবেষণার ভিত্তিতেই পরিবেশমন্ত্রক এবং গৃহমন্ত্রালয়ে আরটিআই-এর আবেদন করেছিলেন ডঃ শেখসরিয়া। তবে সদুত্তর মেলেনি কোথাও-ই। এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই সামরিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে ভারতকে যথেষ্ট অগ্রাধিকার দেবে এই প্রকল্প। তবে ‘সাস্টেইনেবল ডেভলপমেন্ট’ করতে গেলে, বিকল্প অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে বলেই সতর্ক করছেন ডঃ শেখসরিয়া। নাহলে ঘনিয়ে আসবে বিপর্যয়। ভারতের বুক থেকে মুছে যেতে পারে আরও কিছু প্রাচীন সংস্কৃতি…
Powered by Froala Editor