নদীর দু-ধার ঘেঁষে জাহাজের ‘সমাধিক্ষেত্র’

ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে সমুদ্রতট বরাবর নিরিবিলি জায়গা গ্লোস্টরশায়ার (Gloucestershire)। সবুজের অভাব নেই। সমুদ্র থেকে নদী আর খাল ভিতরে ঢুকে এসে যেন কয়েকভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে অঞ্চলটিকে। পার্টন গ্রামের সেভের্ন নদীর পার ধরে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় সমুদ্রতটে। তবে, একটু গা ছমছমে ব্যাপার আছে এখানে। বিশেষ করে সেভের্ন (Severn) নদী যেখানে শার্পনেস খালের সঙ্গে মিশে যায়, সেই জায়গাটাকে লোকে চেনে ‘সমাধিক্ষেত্র’ বলে। মানুষের নয়, জাহাজদের সমাধিক্ষেত্র। আসল নাম ‘পার্টন হাল্কস’ (Purton Hulks)। খালের দুপার ধরে ভেঙে পড়ে আছে জাহাজের সারি। সময় নিয়ে গুণলে, মিলবে আশিটা জাহাজের সন্ধান। সবুজ ঘাসের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে মাস্তুলের ধ্বংসাবশেষ। যেন কোনো সামুদ্রিক দৈত্য এসে এক নিমেষে এখানে উড়িয়ে এনে ফেলেছে সেগুলিকে। 

এরকম অবশ্য ঘটেনি। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় তৈরি হয়নি পার্টনের জাহাজের সমাধিক্ষেত্র। পুরোটার জন্য দায়ী মানুষ। এবং সেটা করা হয়েছে ইচ্ছাকৃত, পরিকল্পনামাফিক। পাগলামি ভর করেছিল নাকি ইংরেজদের মাথায়? এর গল্প শুরু হয়েছে দুশো বছর আগে, ১৮২৭ সালে। তখন গ্লোস্টর-শার্পনেস খালের খুব রমরমা। বহুদিনের চেষ্টার পর সে বছরই খালখননের কাজ শেষ হয়েছে। এবার সমুদ্র থেকে শার্পনেস বন্দরে ছোটো-বড়ো জাহাজ চলাচলের কাজ শুরু হবে। প্রায় ৮৭ ফুট চওড়া আর আঠারো ফুটের কাছাকাছি গভীর ছিল খালটি। লম্বায় ছিল প্রায় ২৭ কিলোমিটার। ৬০০ টনের জাহাজ অনায়াসে যাতায়াত করত এখানে। সেই সময়ের ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড়ো খাল হিসেবে বেশ নামডাক ছিল।

এত আয়োজন করেও কিন্তু বিপদ এড়ানো গেল না। পার্টনের একটি বাঁকে খাল আর সেভের্ন নদীর মধ্যে দূরত্ব একদম কম। জোয়ারের জল ঢুকে নদীর দু-কূল ভাসিয়ে দিতে থাকে। আরও সমস্যা হয় বড়ো জাহাজ ঢুকলে। বর্ষায় ডুবে যায় আশেপাশের গ্রাম। ভাঙতে থাকে নদীর দু-ধার। সমস্যায় জেরবার মানুষ, অথচ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে কীভাবে? সমাধান নিয়ে এলেন এক ইঞ্জিনিয়ার। নাম এ. জে. কুলিস। ১৯০৯ সাল নাগাদ তিনি দিলেন অদ্ভুত এক বুদ্ধি। সারা ইংল্যান্ডের পরিত্যক্ত জাহাজগুলিকে নিয়ে আসা হোক এখানে। তারপর তীব্রবেগে এসে ধাক্কা দেবে নদীর দু-পারে। সেখানেই পড়ে থাকবে জাহাজগুলির দেহ। 

আরও পড়ুন
মাঝসমুদ্রে জাহাজ থেকে উধাও নাবিকরা, আজও অমীমাংসিত ‘এমভি জয়িতা’-র রহস্য

যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। একের পর জাহাজের ধ্বংসস্তূপে ভরে উঠল পার্টনের খালের ধার। নোঙর করে রাখা হল, যাতে প্রবল স্রোতেও সেগুলি ভেসে না যায়। শক্ত কাঠ, লোহা আর কংক্রিটে তৈরি জাহাজের ডেকগুলি করল নদীর পারের বাঁধের কাজ। আটকে গেল পারের ভাঙন। প্রায় ৬০ বছর ধরে ৮০টি জাহাজ এনে ফেলা হয়েছে এখানে। ক্রমে ভৌগোলিক কারণে শার্পনেস বন্দরের গুরুত্ব কমে গেলেও রয়ে গেছে বেসামাল জাহাজদের ‘মৃতদেহ’। এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড়ো জাহাজের সমাধিক্ষেত্রের নাম ‘পার্টন হাল্কস’।

আরও পড়ুন
হারিয়ে যায় জাহাজ, বিমান— বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের যমজ ‘ডেভিল সি’-র কাহিনি

দীর্ঘদিন ধরে শুধুমাত্র গ্লোস্টরশায়ারের মানুষদের কাছেই সীমাবদ্ধ ছিল এই অঞ্চলের পরিচয়। ২০০০ সাল নাগাদ একটি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডের লোকেরা জানতে পারে ‘সমাধিক্ষেত্র’-এর মাহাত্ম্য। প্রত্নতত্ত্ববিদরা শুরু করেন গবেষণা। তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো জাহাজটির নাম ছিল ‘হ্যারিয়েট’। ১৯০৫ সালে তৈরি। ১৯৬৪-তে জাহাজটিকে পার্টন হাল্কস-এ ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের ‘প্রাচীন কীর্তিস্তম্ভ’ রূপে এখন খ্যাতি হয়েছে সেটির। আবার, ‘ডিসপ্যাচ’ নামের জাহাজটা এতই শক্তিশালী ছিল যে একবারে সেটিকে ডোবানো যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকটি জাহাজকেও এখানে সমাধিস্থ করা হয়। তাদের মধ্যে একটি ১৯৯০ সালে গ্লোস্টরশায়ারের বন্দরে পাঠানো হয় প্রদর্শনীর জন্য। সেই নিয়ে যাওয়াও ছিল আলাদা ঝক্কি।

সব মিলিয়ে ‘পার্টন হাল্কস’ এখন একটি ছোটোখাটো পর্যটনকেন্দ্র। সবুজ প্রকৃতি, নিরালা নদী আর ভাঙা জাহাজের সারি দেখতে আসে লোকজন। ইতিহাস আছে, গল্প আছে, একটু রোমহর্ষক ব্যাপারও আছে। কিন্তু রাতবিরেতে কি জেগে ওঠে জাহাজেরা? মিতালি পাতায় নিজেদের মধ্যে? যতই হোক, সমাধিক্ষেত্র বলে কথা...

চিত্রঋণ : Industrial Wales/Flickr

Powered by Froala Editor

Latest News See More