স্টিমার যাত্রা, গোয়ালন্দ চিকেন কারি ও দেশভাগের স্মৃতি

বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ ফেসবুকে কোনো কথা প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল অবিভক্ত ভারতের ৩টি বিখ্যাত ডিশের কথা। রেলওয়ে মাটন কারি, গোয়ালন্দ স্টিমার চিকেন কারি আর ডাকবাংলো চিকেন কারি। ইন্টারনেট নাড়াচাড়া করে রেসিপি খুঁজে রেলওয়ে মাটন কারি করে ফেলি - ছেলেবেলায় খাওয়া এই বিখ্যাত কারির স্বাদের সঙ্গে বেশ মিলে যায়।

ঝামেলা বাঁধে গোয়ালন্দ স্টিমার কারির বেলায়। এই নামজাদা কারির কথা অনেক শুনেছি - কিন্তু খাইনি কখনও। ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম এই কারি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে - অনেকে অনেক কিছু লিখেছেন - তবে এই কারি আদতে কেউ খেয়েছেন এবং তিনি রেসিপি দিয়েছেন, এরকমটা ঠিক মনে হল না। মাইক্রোওয়েভে গোয়ালন্দ চিকেন কারির রেসিপি পর্যন্ত চোখে পড়ল। বুঝতে পারলাম এই কারি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। আর এর ভেতর থেকে আমার নিজের বিচারবুদ্ধি মতো রেসিপি বের করে নিতে হবে। যা মনে হল খুব সাধারণ এর রেসিপি - আর এটিই এর অসাধারণত্ব। শুধু পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, লাল লঙ্কা আর শেষে এক মোচড় লেবু - এই কারির মেরুদণ্ড। গরিব মাঝি মাল্লাদের ঘি গরমমশলা কেনার রেস্তো না থাকারই কথা - আর এই সাধারণ মালমশলা থেকেই তৈরি হয়েছিল এই ব্যতিক্রমী কারি। আর এটাও মাথায় রাখতে হবে, ওই সময়ে মুরগি খুব একটি প্রচলিত মাংস ছিল না হিন্দুদের ঘরে। তাই এই কারির মনমাতানো রং ও গন্ধ গোয়ালন্দ স্টিমারের যাত্রীদের মন চোখ টানত বেশি করে। 

আমার দাদামণি স্বপন ঘটকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম - দাদামণির গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটের নিজের অভিজ্ঞতার কথা। আমার ঠাকুরদা সপরিবারে ১৯৪৭-এ পশ্চিম বঙ্গে চলে আসেন। কিন্তু আমার মামাবাড়ির দাদু থেকে যান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৪ র ঢাকার ভয়ানক রায়টের পর পশ্চিমবঙ্গে আসতে বাধ্য হন আমার মামার বাড়ির দাদু তাঁর পরিবার নিয়ে। তবে সে প্রসঙ্গ আজ থাক।

আরও পড়ুন
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য রান্না ৯৯ বছরের বৃদ্ধার, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিও

দেশভাগের পর ছেলেবেলায় দাদামণি, আমার মা আর বড়োমামার সঙ্গে গোয়ালন্দ ঘাটের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আমার দাদু তখন পদ্মা নদীর ধারে জয়পাড়া বলে একটি ছোটো শহরে থাকতেন। গোয়ালন্দ ঘাট পেরিয়ে দাদামণিদের যেতে হয়েছিল। জাহাজে দাদামণিরা ওপরের ডেকে ছিলেন। তখনকার দিনে ব্রাহ্মণ পরিবারে বাইরের খাবার খাওয়ার বড় একটা রেওয়াজ ছিল না। বড়মামার তত্ত্বাবধানে বাড়ি থাকা আনা লুচি, তরকারি, মিষ্টি, ফল খেয়ে কাটাতে হয় দাদাদের ও আর আমার মাকে। নিচের ডেকে জাহাজিরা জমিয়ে সেই বিখ্যাত গোয়ালন্দ স্টিমার কারির রান্নার গন্ধে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। দাদা ও আমার মা একঘেয়ে লুচি তরকারি খেতে খেতে বিরসবদনে দেখছিলেন জাহাজিদের হই হই করে সেই জিভে জল আনা মুরগির ঝোল আর ভাত খাওয়ার দৃশ্য। এই কারি খেতে না পাওয়ার দুঃখ আজও দাদামণির মনে দগদগে হয়ে আছে। মায়ের কাছেও শুনেছি এই দুঃখের কথা। বড়মামা গোয়ালন্দ ঘাটে মুড়ি ঘণ্ট, রুই মাছের কালিয়া খাওয়ালেও - সেই দুঃখের ওপর প্রলেপ পড়েনি।

ইন্টারনেট আর ফেসবুকের জন্য এই বিখ্যাত কারি বিলেতে বসে রান্না করে খাওয়াতে পারলাম দুজনকে। ওরা খুব খুশি হল। বলল খুব আলাদা রকম এই কারিটা। তবে আমার এই কারিটি খেয়ে মনে হল - কেমন একটা খামতি থেকে গেছে যেন রান্নায়। দেশে গিয়ে দাদামণি আর ভাইকে রেঁধে খাওয়াই এই কারি। গুঁড়ো হলুদ আর গুঁড়ো শুকনো লঙ্কার বদলে শিলনোড়ায় গোটা হলুদ আর শুকনো লঙ্কা বাটিয়ে নিলাম। মিহি করে। আর বাজার থেকে দেশি মুরগি নিয়ে এলাম। বিলেতের খামতিটা পূরণ হয়েছে বলেই মনে হল। দাদামণি বললেন - খাইয়া তো দেখি নাই সেই কারি, তবে গন্ধখান ঐরকমই লাগতাসে।

আরও পড়ুন
রান্নার তেলে ছুটবে গাড়ি, পরিবেশ বান্ধব নতুন প্রযুক্তি ভারতে

মা, বাবা আর বড়মামাকে কোনদিন পারব না খাওয়াতে। দেশভাগের বহু অভিমান বুকে জমিয়ে ওঁরা অনেক দূরে চলে গেছেন। 

খাওয়ার সময় নির্মলেন্দু চৌধুরীর ‘সাগর কুলের নাইয়া’ চালিয়ে দিলাম সাউন্ড সিস্টেমে। পদ্মাপাড়ের আর অনেক অনেক স্মৃতির বেশ খানিক নোনতা ভেজা আভাস কলকাতার বাতাসে ভেসে এল...

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More