এই বছর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী প্রসবের সময় মাতৃমৃত্যু হ্রাস এবং সামগ্রিক পুষ্টির স্তর উন্নত করার দিকে নজর দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। উপায় হিসেবে মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের কথাতেও এই প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল। যদিও যুক্তির দিক থেকে দেখলে এবং তার সঙ্গে যদি বিশ্বব্যাপী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তাহলে কিন্তু অন্যরকম একটা ছবিই দেখা যায়। এই উপায়ে লাভের লাভ কতটা কী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ জাগা তাই স্বাভাবিক।
মহিলাদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারটিকে মাথায় রাখলে বিশ্বব্যাপী যেসব উদাহরণ ছড়িয়ে আছে, তাতে একটি ব্যাপার পরিষ্কার। মাতৃমৃত্যু রোধ করতে বা মহিলাদের পুষ্টি-স্তর উন্নত করার জন্য সবার আগে দরকার তাদের প্রজনন অধিকারকে সম্মান করা। এটা ছাড়া অন্য যে পন্থাই নেওয়া হোক না কেন, তাতে কিন্তু আখেরে ছবিটায় খুব বেশি বদলের আশা না রাখাই ভাল।
বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধকরণ আইন কার্যকর হওয়ার ৪০ বছর পরেও ১৮ বছরের কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য কিন্তু দেখা যায়নি। যদিও গত দশক থেকে কিছুটা উন্নতির লক্ষণ দেখা গিয়েছে পরিসংখ্যানে। তবে লকডাউনের সময়েই যে আবার বদলাতে শুরু করেছে পরিস্থিতিটা, হিড়িক বেড়েছে বাল্যবিবাহের, সেই পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছিল সরকারের তরফেই।
ঠিক কতটা বদলেছে পরিস্থিতি? বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। ১৯৯২-৯৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মেয়েদের, যাদের বিয়ে হয়েছিল ১৮ বছরের কম বয়সে, তার সংখ্যা ছিল ৫৪ শতাংশ। ১৯৯৮-৯৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে এবং ২০০৫-০৬ সালে ৪৭ শতাংশে। তারপর থেকেও এই সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে গত দশকে। তবু আশার আলো দেখা যাচ্ছে না কেন? কারণ, এত কিছুর পরেও বাল্য বয়সেই আইন লঙ্ঘন করে বিয়ে হয়েছিল প্রায় দেড় কোটি মেয়ের। এবং তার থেকেও বড় কথা, ব্যাপক আইন লঙ্ঘন হলেও আমাদের দেশে তাকে 'অপরাধ' হিসেবে রেকর্ড করার সংখ্যা প্রায় নগণ্য।
আরও পড়ুন
বাড়িতে বসে, বই খুলেই পরীক্ষা; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়া সিদ্ধান্ত ও কিছু সংশয়
২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো জানিয়েছিল যে এই বিষয়ে তদন্তের জন্য দায়ের হয়েছিল কেবল মাত্র ৭৫৩টি মামলা। এই পরিস্থিতি এবং এই রেকর্ডকে বিবেচনা করে ১৮ বছরেরও বেশি বয়সে বিবাহের জন্য ন্যূনতম আইনি বয়স বাড়ানোর চেষ্টা করার যুক্তি সন্দেহজনক।
সমাজবিজ্ঞানীরা বারবারই জানিয়েছেন যে, যতই আইন থাকুক না কেন সমাজে পারিবারিক রীতিনীতি বদলানোর জন্য বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। একটু যুক্তি দিয়ে ভাবলেই ভারতে এই বিপুল পরিমাণ বাল্যবিবাহের কারণটা ধরতে পারা যাবে। যত ছোট বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হবে, ততই কম বহন করতে হবে পণ অথবা যৌতুকের বোঝা। এছাড়াও দেখা গিয়েছে অবিবাহিত মেয়েদের কুমারিত্ব হারানোর কলঙ্ক এবং তারফলে পারিবারিক সম্মানের ক্ষতি হওয়ার ভয়ে জর্জরিত থাকে অসংখ্য পরিবার। মেয়ের বিয়ে না দেওয়া অবধি "লোকে কী বলবে", এই সমস্ত মধ্যযুগীয় ভাবনা বাল্যবিবাহ আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে বারবার।
আরও পড়ুন
কলেজের মেধাতালিকায় পর্নস্টারদের নাম; শিক্ষাব্যবস্থার ‘ঠাট্টা’ই কি নগ্ন হয়ে উঠল আরও?
পরিসংখ্যান বলছে এক দশক ধরে ভারতে বাল্যবিবাহ বিশেষ হারে হ্রাস পেয়েছে। তবে জোর করে আইনের বড়ি গিলিয়ে দেওয়ার কারণে কিন্তু তা ঘটেনি। বরং আরও বেশি করে মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া, এবং নিয়মিত তাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার পথে চালিত করা এর কারণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে। এর ফলে মেয়েদের মানসিকতায় মৌলিক পরিবর্তন এসেছে এবং বহু ক্ষেত্রেই তারা নিজেরাই কম বয়সে বিয়ের ক্ষেত্রে তীব্র অনিচ্ছার কথা জানিয়েছে।
তবুও, বাস্তব ছবিটা হল, ঠিক যেই সময় প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে এই কথা জানাচ্ছেন, তখন অতিমারী পরিস্থিতিতে সহায়-সম্বলহীন পরিবারেরা নিতান্ত নিরুপায় হয়েই ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন বাধ্য হয়ে। তাই এই প্রবণতা কমানোর জন্য কোনও নতুন আইন নয়, বরং প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা এবং আরও ভিতরে গিয়ে সমস্যাটাকে দেখার চেষ্টা করা। যতদিন পর্যন্ত না সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচির মধ্যে কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে দেশের দরিদ্র সম্প্রদায়কে, ততদিন এই ছবিটা বদলানো অসম্ভব। সুতরাং নীতি ও কর্মসূচি আইন প্রণয়নের আগেও মাথায় রাখতে হবে মানবাধিকারের বিষয়টি। তাহলেই আরও সম্মানজনক এবং যথাযথভাবে এই সমস্যার ভিতরে গিয়ে এটাকে সমাধান করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। যার ফল কিন্তু পাবে আমাদের দেশের মেয়েরা, এবং অবশ্যই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor