এবার থেকে আর চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তৈলবীজ, ভোজ্যতেলের মতো কৃষিপণ্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আওতায় থাকবে না। এমন সিদ্ধান্ত নিয়েই কেন্দ্র সরকারের নতুন বিল পাশ হয়ে গেল রাজ্যসভা ও লোকসভায়। এর আগেই কেন্দ্রের কৃষি বিল নিয়ে উত্তেজনার পারদ চরমে। তার মধ্যেই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সংশোধনী বিল বিতর্কের উত্তাপ বাড়িয়ে দিল।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর এই বিল পাশ হয়েছিল লোকসভায়। ২২ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভাতেও ছাড়পত্র পেল এই বিল। ভোটের ভিত্তিতেই। এবার শুধু অপেক্ষা রাষ্ট্রপতির সাক্ষরের। কার্যত তারপরই আইনে পরিণত হবে সরকারের এই সিদ্ধান্ত। এই বিল কার্যকর হলে কৃষিজাত এই সব পণ্যের বিক্রি, মজুত, বণ্টন এবং উৎপাদনের ওপরে আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না কেন্দ্রের।
স্বাধীনতার ঠিক আট বছর পরে ১৯৫৫ সালে ভারত সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের এই আইন প্রণয়ন করেছিল। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যাতে খাদ্য সংকট তৈরি না হয়, তার জন্যই তৈরি হয়েছিল এই আইন। লক্ষ্য ছিল বেঁচে থাকার অন্যতম এই রসদগুলির দাম যেন সারা ভারতে অভিন্ন থাকে। পাশাপাশি বেআইনি খাদ্যশস্য মজুতকেও আয়ত্তে আনতে সরকার হেঁটেছিল এই পথে। তার প্রায়ত ৬৫ বছর পরে বন্ধ হতে চলেছে এই ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ।
১৯৫৫ সালে আইন প্রণয়নের সেই প্রেক্ষাপটের প্রসঙ্গ তুলেই বর্তমান কেন্দ্র সরকার দাবি করেছে, খাদ্য সংকটের পরিস্থিতি এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে অপ্রাসঙ্গিক। খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে ভারত এখন পৃথিবীর অন্যতম রপ্তানিকর দেশগুলির একটি। প্রতিবছরেই বাড়তি থেকে যায় খাদ্যশস্য। সুতরাং, এই আইনের প্রয়োজনীয়তা আর নেই ১৩৩ কোটির দেশে। তবে বন্যা, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় সরকার এই ক্ষেত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
ক্রেতা সুরক্ষা এবং খাদ্যদপ্তরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্য ঘিরেই বেশ কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বের বিলিয়নিয়ারের তালিকায় বেশ কিছু নতুন ভারতীয় ব্যক্তিদের নামের উল্লেখ যেমন অবনমিত অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রতিফলিত করে না। বরং তার ঠিক উল্টো প্রতিচ্ছবি। তেমনই খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত থেকে যাওয়ার মানেই কি দেশে সকল নাগরিকদের মধ্যে সমবণ্টন হচ্ছে খাদ্যের? নাকি রপ্তানিকর দেশ হয়ে যাওয়ায় নাগরিকদের কাছে জীবননির্বাহের জন্য চাল, ডাল, আলু, ভোজ্য তৈলের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে?
অত্যাবশ্যকীয় পণের তালিকা সংশোধনে কেন্দ্রের দাবি এতে কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়বে বহুগুণ। পাশাপাশিই মজুতের উর্ধ্বসীমা উঠে যাওয়ায় কৃষকদের ফসল নষ্টের, বিক্রি না হওয়ার ভয়ও থাকবে না। উপকৃত হবেন কৃষক ও উপভোক্তা দুই পক্ষই। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা নিজেদের লাভ নিশ্চিত না করেই সেই পণ্য বাজারে আনবে, এমন ভাবাটা খানিকটা কি বোকামি নয়? কৃষকরাও যে ন্যায্য মূল্য পাবেন না, রয়ে যাচ্ছে সেই সম্ভাবনাও। অন্যদিকে সাধারণ মানুষকেও আগের তুলনায় হয়তো বেশি দামেই কিনতে হবে এইসব সামগ্রী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একই দ্রব্যের দামের চরম অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়াও কিছু অস্বাভাবিক হবে না পরবর্তীতে। পাশাপাশি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাইরে চলে গেলে সাধারণ মানুষকে দিতে হতে পারে বাড়তি জিএসটি’র টাকা। যদিও এখনও অবধি তেমন কোনো ঘোষণা করেনি সরকার।
আরও পড়ুন
আলোচনার বালাই নেই, কেন্দ্রের একের পর এক ‘সংস্কার’ বিলে ধরাশায়ী কৃষক-শ্রমিকরা
২০১৮ সালে ক্ষুধার সূচকে ভারতের স্থান ছিল পৃথিবীতে ৯৭। এক বছরের মধ্যেই সেই জায়গা থেকে সরে এসে ভারত ১১৭টি দেশের মধ্যে নেমেছে ১০২-তে। তারপরেও সরকারের এমন মন্তব্য খানিকটা যেন অবান্তরই। প্রধান খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন, মজুত এবং বণ্টনে সরকারের এই ঔদাসিন্য যেন নিজের ঘাড় থেকে পরিস্থিতি আয়ত্তে না আনতে পারার দায় ঝেড়ে ফেলাকেই চিহ্নিত করে। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, দেশের সরকার কতটা নির্ভরতা দিতে পাচ্ছে আম-জনতাকে, সেই প্রশ্নই থেকে যাচ্ছে যেন...
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
'অপরাধ' কৃষি বিলের প্রতিবাদ – রাজ্যসভা থেকে বহিষ্কৃত ৮ সাংসদ, রয়েছেন বাংলার দুই প্রতিনিধিও