পার্ক স্ট্রিটের নামী রেস্তোরাঁ-হোটেলগুলোয় গান বাজনার আসর বসত সন্ধ্যায়। সময়টা ষাট-সত্তরের দশক। ক্রমশ আগুনের আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যেই পাওয়া গেল ফর্সা, রোগা, একমুখ দাড়ি আর চুলের এক বোহেমিয়ান ছেলেকে। চেহারা দেখে কেউ কেউ হিপি বলেও সন্দেহ করত। তাতে থোড়াই কেয়ার ওই ছেলের! বাড়ির পুরনো হাওয়াইয়ান গিটারটাকে স্প্যানিশ করে নিয়ে চলছে গান বাজনা। ওই হোটেলে ছেলেটা গাইত বিটলস, বব ডিলান, জিম মরিসনের গান। বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, তার ওপর ব্রাহ্মণ— পড়াশোনা, শিষ্টাচার জলাঞ্জলি দিয়ে কিনা হোটেলে গান গাইছে!
কিন্তু ছেলেটার রক্তে বোহেমিয়ান সত্তা তো ঢুকে গেছে। সেইসঙ্গে ঢুকেছে বিশ্বসঙ্গীত, রক, গিটার; আর বাংলার চিরন্তন বাউল। ইতিমধ্যেই জোরালো হল আগুনের শিখা। গোটা বাংলায় ছড়িয়ে গেল নকশালবাড়ির আওয়াজ। দলে দলে ছাত্র, যুবকরা রাস্তায় নেমে এল। সেই দলে নাম লেখাল লম্বা চুল-দাড়ির বোহেমিয়ান ছেলেটা। এর পরে গড়িয়ে গেছে কত সময়। বদলে গেছে চালচিত্র। কিন্তু বদলায়নি ছেলেটা। ভাগ্যিস বদলায়নি! গৌতম চট্টোপাধ্যায়দের বদলে গেলে চলবে নাকি! ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ তাহলে কি করে ঘাস খাবে কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে…
গৌতম চট্টোপাধ্যায় ওরফে ‘মণিদা’ বাংলার গানের জগতে এক ঝড়ের নাম। যিনি এলেন, দেখলেন, লড়াই করলেন; এবং শেষে জয়ও করলেন। তিনি যখন এসেছিলেন, বাংলার সঙ্গীত জগত তখন হেমন্ত-মান্না-কিশোরে মজে। সে যেন আলাদা জগত। কিন্তু বিশ্বসঙ্গীতের থেকে কোথাও যেন ছিটকে আছে বাঙালি। দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি, বাবা বিজ্ঞানী। তবে গান-বাজনার আবহ ছিলই। কিন্তু বোহেমিয়ান গৌতম এসবে বেশিদিন মজে থাকেননি।
প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিওলজি নিয়ে পড়ার সময়ই শুরু হয় গিটার-প্রেম। গৌতম চট্টোপাধ্যায় তখন কলেজ চত্বরে পরিচিত মুখ। শুধু গানই নয়, তাঁর মুখে উঠে আসছে রাজনীতির কথা। শোষিত শ্রেণীর কথা। ইতিমধ্যেই ‘আর্জ’ নামের গানের দলও তৈরি করেছেন। পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে চলছে গান। কিন্তু সেসব তো ইংরেজি গান! দেশের মানুষের লাছে পৌঁছতে গেলে, তাঁদের কথা বলতে গেলে তো সেটা ছাড়তে হবে। বাংলা গানেরই হাত ধরতে হবে। একসময় গৌতম ছাড়লেন নিজের দলটিও।
এর পরের কাহিনি সংগ্রামের কাহিনি, লড়াইয়ের কাহিনি। নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি আসা কমে গেল আরও। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন পার্টির কাজে। বলা ভালো, এখান থেকেই আরও সমৃদ্ধ করতে শুরু করলেন নিজেকে। মাঠে গিয়ে ধান বুনলেন, কৃষক-শ্রমিকদের কথাগুলো শুনলেন। শুনলেন বাউলের গান। কিন্তু গিটারটি ছাড়লেন না। সব নিয়ে বেড়ে উঠলেন তিনি। একসময় গ্রেফতারও হলেন। ততদিনে বেহালার চট্টোপাধ্যায় পরিবারেও হানা দিয়েছে পুলিশ। গৌতমেরও হয়ত নিয়তি ছিল মৃত্যু, অন্যান্য বন্ধুদের মতোই। কিন্তু হল না; দেড় বছর পর ছাড়া পেলেন জেল থেকে। বেছে গেলেন তিনি। তারপর প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির আঙিনায় না নামলেও, সেই আদর্শ, সেই স্বপ্ন কোনোদিনও হারায়নি তাঁর মধ্যে থেকে।
গানের জন্য সব ছেড়েছেন একসময়। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন কলকাতায়। আর তারপরই শুরু হয় এক কিংবদন্তি অধ্যায়ের। যার নাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে হাজির হলেন রঞ্জন, প্রদীপ ওরফে বুলা, রঞ্জন, অ্যাব্রাহাম, বিশু-সহ তরুণ গানপাগলরা। সত্যিই পাগল; আর সেজন্যই বাংলা গানের জগতে খুলে গেল এক নতুন জানলা। শুরুতে অবশ্য দলের নাম ছিল ‘সপ্তর্ষি’। পরে রঞ্জন ঘোষালের দেওয়া ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নামটিই সবাই গ্রহণ করল। জীবনানন্দের কবিতারা কি কখনও এমন ভেবেছিল?
‘হায় ভালোবাসি’, ‘কলকাতা’, ‘রানওয়ে’, ‘টেলিফোন’ থেকে ‘পৃথিবীটা নাকি…’— এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এই গানগুলো আজও কাল্ট তকমা ধরে রেখেছে। ‘পৃথিবীটা নাকি’ তো বাংলা ব্যান্ডের থিম সং হয়ে গেছে এখন! গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের চেতনা, দর্শন, রাজনৈতিক দীক্ষা-দৃষ্টি সবই মিলে মিশে গিয়েছিল গানে। কিন্তু শুরুর দিকে, সত্তরের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকেও এই গানগুলির কদর ছিল না। বরং অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে। আকাশবাণীতে বলা হয়েছে এসব নাকি কোনো গানই নয়। অবশ্য এসবে দিব্যি মজা পেতেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা। পরে রেডিও বলুন বা পাড়ার ফাংশান— বাংলা ব্যান্ডের গানের কথা এলে ‘মহীনের’ গান আসবে না, এ হতেই পারে না! বাংলা গানেও যে বিশ্ব সঙ্গীতের ছোঁয়া রাখা যায়, সেটাই ভাবতে শেখালেন তিনি।
মহীনের গানগুলির আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল - গানের নাম। এমন চমকভরা, গভীর নামকরণ এর আগে বাংলা সঙ্গীতজগত দেখেছে কি? তবে এই বিষয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, বুলাদের সঙ্গে ছিলেন আরও একজন, তিনি রঞ্জন প্রসাদ। বাংলা গানের নামকরণ এবং লিরিক এঁর হাত ধরেও একটা গতি পায়। মহীনের ঘোড়াগুলি-র পথচলা তখন শুরু হয়েছে একটু একটু করে। তার সদস্যদের সঙ্গেও একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছে রঞ্জন প্রসাদের। আর সখ্যতার জেরেই জুড়ে গেলেন 'রানওয়ে নয়', 'সংবিদ্ধ পক্ষীকূল'-এর সঙ্গে। এইভাবেই একটা নিবিড় যাপন তৈরি করেছিল ইতিহাস। একটা সময় ব্যান্ড ভেঙে গেলেও, নব্বইয়ের দশকে কয়েকজন গানপাগল তরুণ-তরুণীর প্রবল উৎসাহে গৌতম চট্টোপাধ্যায় সামনে নিয়ে এলেন মহীন’কে। সম্পাদনা করলেন চারটি অ্যালবাম। আবার কেঁপে গেল বাংলা গানের জগত। বাকিটা, ইতিহাস…
খাঁটি বোহেমিয়ান, সাধক বলতে যা বোঝায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেরকম। প্রায় সমস্ত রকম যন্ত্র বাজাতে পারতেন। গান, সুর— এটাই ছিল প্রাথমিক নেশা। তাঁর তৈরি সিনেমা ‘নাগমতী’ পেয়েছে জাতীয় পুরস্কার। কিন্তু মহীনের মর্যাদা দেখে যেতে পারলেন না। তার আগেই নেমে এল মৃত্যুর থাবা। বিপ্লবীরা বোধহয় এরকমই হন। আসেন, দেখেন, সব ছারখার করে দিয়ে চলে যান। এক অদ্ভুত ইউটোপিয়ান স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, দেখিয়েছিলেন আমাদের। নবারুণ ভট্টাচার্য যথার্থ বলেছিলেন, “রেবেলদের ভাগ্য দুঃখেরই হয়। স্পার্টাকাস থেকে চে গুয়েভারা, দেখতে দেখতে মনের চোখের সয়ে যাওয়ারই কথা। গৌতম তাঁদেরই একজন। ট্র্যাজিক এবং বিজয়ী।”
তথ্যঋণ—
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘স্বপ্নেও বিপ্লবেরই রং দেখতেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়’
২) ইরাবতী ডট কম
Powered by Froala Editor