বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার একপ্রান্তে একটি বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়ালেন তরুণ। ঘাড়ে ক্যামেরা, ট্রাইপড। কাঁধের ব্যাগে ছবি আঁকার সরঞ্জাম। ধ্যানমগ্ন হয়ে বাড়ির উঠোনে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন... পথচলতি মানুষের কটাক্ষ-ফিসফাস অগ্রাহ্য করে। হঠাৎ বেরিয়ে আসেন বাড়ির মালিক। বেশ কড়া সুরে বলেন, ‘কী দেখছো ছোকরা?’ জবাব আসে, ‘মাকড়সা!’
এই অসম্ভব উত্তরের পর বাছা বাছা বিশেষণ সহ, ভরদুপুরে রাস্তার মাঝে গলাধাক্কা খেতে হয়েছিল বাংলার অন্যতম পতঙ্গবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে। এর কয়েক দশক পরেই বিজ্ঞানী, টিনবার্গেন, ফ্রিশ আর লোরেঞ্জ নোবেল পেয়েছিলেন, তাঁরই গবেষণাপ্রণালীকে বিশ্বের দরবারে হাজির করে। বাঙালি মনে রাখে না।
১৮৯৫ সালে ফরিদপুরের লোনসিং গ্রামে জন্মেছিলেন শ্রীভট্টাচার্য। বাবা দরিদ্র পুরোহিত। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস ছিলেন গ্রামের জমিদারবাড়ির ছেলে। সেখানেই বংশানুক্রমে পূজা-অর্চনায় দিন গুজরান করতেন গোপালচন্দ্রের বাবা। পুত্র অবিশ্যি স্কুল ফাইনাল পাশ করে ভূগোল শিক্ষকের চাকরি পান। গ্রামের স্কুলেই। ফাঁকে ফাঁকে খ্যাপার মতো ঘোরেন মাঠে ঘাটে। ১৯১৯ সালে প্রবাসীতে তাঁর লেখা একটা প্রবন্ধ চোখে পড়ল আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর। শিরোনাম : ‘পচা গাছপালার আশ্চর্য্য আলো বিকিরণ করিবার ক্ষমতা’। সহজ সরল ভাষায় লেখা। পড়েই চমকে ওঠেন আচার্য। খুঁজে পেয়েছেন হিরে! তৎক্ষণাৎ পুলিনবিহারীকে তলব করে, তরুণকে নিয়ে আসেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে। শেখানোর ব্যবস্থা করেন ছবি আঁকা, ফোটোগ্রাফি, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। কিনে দিয়েছেন ক্যামেরা। তিলে তিলে আচার্য-র হাতে গড়ে উঠছিলেন গোপালচন্দ্র। তবে প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া যে কোথাও স্বীকৃতি মেলে না! ১৯২৪ তিনি সালে, আই এস সি পরীক্ষায় বসতে চাইলে আচার্য বাধা দিয়েছিলেন। ‘বি এস সি, এম এস সি করতে চাইলে তোমাকে আমার দরকার নেই। অন্যত্র কাজের সন্ধান করো।’ পরবর্তী কালে এর জন্য ভুগতে হয়েছিল। কিন্ত জগদীশচন্দ্রও হয়তো, তাঁর প্রিয় শিষ্যকে শিক্ষাব্যবস্থার জাঁতাকলে পিষে মারতে চাননি।
আজকের দিনে বিজ্ঞানের সুপরিচিত শাখা হিসেবে গণ্য করা হয় 'ইথোলজি'কে। ইথোলজি হল প্রাণীদের আচার ব্যবহার পর্যবেক্ষণ। এর সর্বপ্রথম প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয় চার্লস ডারউইনকে। তবুও গোপালচন্দ্র, বাংলার বিজ্ঞানচর্চার জগতে ইথোলজিস্ট কেন, একজন বিজ্ঞানী হিসেবেও দীর্ঘদিন জায়গা পাননি। কারণটা অনুমেয়। তাঁর অধিকাংশ লেখাই যে মাতৃভাষায়! বিদেশ থেকে স্বীকৃতি এলেও, পিঁপড়ের একটি প্রজাতি নিজের মেয়ের নামে নামাঙ্কিত হলেও, গেঁয়ো যোগীর ভিখ মেলে না। মাঠেঘাটে ঘুরে জুটেছিল অপমান, প্রহার। প্রকৃতিপাগল গোপালচন্দ্র হার মানেননি। বাড়ির দেয়ালে, গাছের ছায়ায়, রাঙামাটির পথে খুঁজেছেন 'কুমোরে পোকা', 'মাকড়শা', পিঁপড়ে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখেছেন প্রাঞ্জল ঝরঝরে গদ্যে। ১৯৭৫-এ প্রকাশিত হয় ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’। নিয়মিত লিখতে লিখতে মিলেছে রবীন্দ্র পুরস্কার। তা অবিশ্যি 'বিজ্ঞান-লেখক' হিসেবে। মজার ব্যাপার এই যে, পতঙ্গবিদ্যার জনক ফ্যাবার তাঁর অধিকাংশ গবেষণাপত্রই লিখেছেন ফরাসিতে। মাতৃভাষায়।
ঔপনিবেশিক শিক্ষার শাসনযন্ত্রে, বিজ্ঞানী-‘না-বিজ্ঞানী'র ঘেরাটোপে ঘুরতে থাকা গোপালচন্দ্র ঠাঁই পেয়েছেন প্রকৃতিপ্রেমিক বাঙালির বই-এর তাকে। প্রাপ্তি বলতে, হয়তো এটুকুই।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মৃত্যুর দেড় বছর পর, স্ত্রী-কে হৃদয়বিদারক চিঠি লিখলেন নোবেলজয়ী রিচার্ড ফাইনম্যান