ক্যানসারের জন্য যে জিনগত মিউটেশন দায়ী আর তার সঙ্গে যে বংশগতির সম্পর্ক রয়েছে, এ-কথা আজ সকলেরই জানা। তবে এই যোগসূত্র আবিষ্কার করেছিলেন যে বিজ্ঞানী, তাঁর কথা অনেকেই মনে রাখেননি। তিনি ডঃ কমল রানাদিব (Dr. Kamal Ranadive)। ভারতীয় তো বটেই, তিনি এ-দেশের হাতে গোনা মহিলা বিজ্ঞানীদের একজন। কোষবিজ্ঞান বা সাইটোলিজির উপর অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার পাশাপাশি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতে মহিলাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক শিক্ষার প্রসার, এমনকি গ্রামাঞ্চলে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গিয়েছেন তিনি। আজ তাঁর ১০৪ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাল গুগল। মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখা কমল রানাদিবের ছবি নিয়েই তৈরি হয়েছে আজকের গুগল ডুডল (Google Doodle)।
১৯১৭ সালের ৮ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের পুনে (তৎকালীন পুণা) শহরে জন্ম কমলের। বাবা দীনেশ দত্তাত্রেয় সমরাথ ছিলেন পুনের ফার্গুসন কলেজের জীববিদ্যার অধ্যাপক। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে তিনি কোনোরকম বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেননি। আর তাই বাবার কাছ থেকেই বিজ্ঞান শিক্ষার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কমল। অবশ্য দীনেশ চেয়েছিলেন মেয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করুক। কিন্তু বাবার মতোই জীববিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন কমল। ফার্গুসন কলেজ থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। এরপর বিশেষ বৃত্তি নিয়ে চলে যান বাল্টিমোরের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে।
আমেরিকার পড়াশোনা শেষ করে কমল যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন মুম্বাই শহরে সদ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে ইন্ডিয়ান ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার। সেখানেই প্রথমে সিনিয়ার সায়েন্টিফিক রিসার্চ অফিসার হিসাবে যোগ দিলেন তিনি। পরে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সংস্থার ডিরেক্টরের দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। এই সময়েই দেশের মহিলাদের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি তৈরি করেন ইন্ডিয়ান ওম্যান সায়েন্টিস্টস’ অ্যাসোসিয়েসন। সেইসঙ্গে যে সমস্ত ভারতীয় বিজ্ঞানী বিদেশে থেকে গবেষণা করছেন, তাঁদের দেশে ফিরে আসার আবেদনও জানাতে থাকেন। তাঁদের গবেষণার উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরির দাবি নিয়ে সরকারের দ্বারস্থও হয়েছেন।
পাশাপাশি চলতে থাকে গবেষণার কাজ। মুম্বাইয়ের আইসিআরসি-তে বসেই ক্যানসারের সঙ্গে বংশগতির যোগসূত্র আবিষ্কার করেন কমল রানাদিব। ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কিছু ভাইরাসকেও চিহ্নিত করেন তিনি। আর তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছিল ব্রেস্ট ক্যানসার নিয়ে। ভারতের মতো দেশে ব্রেস্ট ক্যানসার নিয়ে নানা কুসংস্কার ছড়িয়ে ছিল। সেইসবের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচারও শুরু করেন তিনি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর এমিরেটাস গবেষক হিসাবেও কাজ করেছেন তিনি। সারাজীবন বিজ্ঞান গবেষণার স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন পদ্মভূষণ পুরস্কার।
১৯৮৯ সালে গবেষণার জগত থেকে সরে আসেন রানাদিব। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়েন অন্য এক কর্মযজ্ঞে। মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের নিয়ে তৈরি করেন বিশেষ দল। খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে প্রচার শুরু করেন তিনি। এই সময় বেশ কিছু সরকারি প্রকল্পের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি। বিজ্ঞান শিক্ষা, গবেষণা পরিকাঠামো এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে যে সমস্ত সংস্কার কর্মসূচি গড়ে তুলেছিলেন তিনি, আজও সেই পথ ধরে এগিয়ে চলেছে দেশ।
Powered by Froala Editor