ছোটো থেকেই বন্ধুদের কাছে বারবার অপদস্ত হতে হত তাঁকে। অথচ ভিতরে ভিতরে মানুষটা ছিলেন অত্যন্ত নম্র। বেঁটেখাটো দুর্বল শরীর। স্কুলের ক্লাসের শেষে অনেকসময় বন্ধুরা ধরে মারধোরও করত। আত্মরক্ষার জন্যই জুজুৎসু শিখতে শুরু করলেন তিনি। শিখেছিলেন খোদ প্রাক্তন সামুরাই ফুকুদা হাচিনোসুকের কাছ থেকে। কিন্তু সেই খেলাকেই আমূল বদলে ফেললেন একদিন। জুজুৎসুর নানা বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী আক্রমণের পদ্ধতি তিনি বাদ দিয়ে দিলেন। অথচ তাতে খেলোয়ারদের শক্তি যেন এতটুকু কমে না যায়, নজর রাখলেন সেদিকেও। জাপানি জুজুৎসুর সঙ্গে পাশ্চাত্য মার্শাল আর্টের কিছু পদ্ধতি মিশিয়ে তৈরি করলেন জুডো (Judo)। ছোটোখাটো চেহারার মানুষটি সামান্য কিছু প্যাঁচে ঘায়েল করছিলেন বিখ্যাত সব রেস্টলারকেও। কালক্রমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল জুডো খেলার খ্যাতি। আজ জুডোর জনক অধ্যাপক কানো জিগোরোর (Kano Jigoro) ১৬১ তম জন্মদিন। আর এই দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতেই গুগলের তরফ থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ ডুডল।
১৮৬০ সালে মিকাগে শহরে (বর্তমান কোবে প্রদেশে) জন্ম হয় কানো জিগোরোর। ১১ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে চলে আসেন টোকিও শহরে। জুজুৎসু খেলোয়াড় হিসাবে আগেই নাম করে গিয়েছিলেন কানো। ১৮৮২ সালে টোকিও শহরে তৈরি করলেন নিজের একটি প্রশিক্ষণ সংস্থা। যার নাম কোডোকান জুডো ইনস্টিটিউট। তবে এখানে চিরাচরিত জুজৎসুই শেখানো হত। কানোর সঙ্গে প্রশিক্ষণ করাতে প্রায়ই হাজির থাকতেন তাঁর শিক্ষক ঈকুবো সুনেতোসি। একদিন ঈকুবোর সঙ্গে লড়াইয়ের সময়েই কানো বেশ কিছু পাশ্চাত্য কায়দা প্রয়োগ করলেন। আর তাতেই দেখা গেল, জুজুৎসুর সবচেয়ে বিপজ্জনক কায়দাগুলি দিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারলেন না ঈকুবো। পরাজয় স্বীকার করতে হল তাঁকে। এরপর ঈকুবোর পরামর্শেই সম্পূর্ণ নতুন করে জুডোর পদ্ধতি তৈরি করতে বসলেন কানো। এই সময় দুটি বিষয়ের উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন। প্রথমত, সেইরিয়েকু জেনিও অর্থাৎ সবচেয়ে কম পরিশ্রমে সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রয়োগ। আর দ্বিতীয়টি হল, জিতা কিওয়েই অর্থাৎ মিলিত উন্নতি। আর তাই জুজুৎসুর চেয়ে জুডো অনেক বেশি নিরাপদ হয়ে উঠল। শারীরিক আঘাতের সম্ভাবনাও কমে গেল বহুদূর।
১৮৮২ সালে মাত্র ১২ জন ছাত্রকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন কানো। ১৮৯২ সালের মধ্যে সেই সংখ্যাটা ১০০ ছাড়িয়ে গেল। তাছাড়া, জুজুৎসুতে বিপদের আশঙ্কা থাকার কারণে মহিলারা কেউই এগিয়ে আসতেন না সেভাবে। কানোর কাছে প্রশিক্ষণ নিতে এলেন বহু ছাত্রীও। খেলার নিয়মকানুনের পাশাপাশি তার শিক্ষাপদ্ধতি নিয়েও ভাবনাচিন্তা করেছেন কানো। আসলে তিনি তো একজন শিক্ষাবিদই। এই সময়েই জাপান সরকারের হয়ে নানা জায়গায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কাজও করে যাচ্ছিলেন। জুডো শিক্ষাতেও তিনি নিয়ে এলেন পরীক্ষা পদ্ধতি। দান র্যাঙ্কিং-এর পাশাপাশি ব্ল্যাক-বেল্ট এবং হোয়াইট-বেল্ট ব্যবস্থারও জন্ম দিলেন তিনি।
কানোর শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধও দেখা দিয়েছিল প্রথমদিকে। জাপানি শিক্ষাব্যবস্থায় তখন জাঁকিয়ে বসেছিল অভিজাততন্ত্র। সেটাই ভাঙতে চেয়েছিলেন কানো। তারই অংশ হিসাবে নানা স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জুডো শিক্ষাও শুরু করেন। প্রথমদিকে প্রশাসন বিরোধিতা করলেও পরে কানোর জনপ্রিয়তার কাছে হার মানতে হয়েছিল তাঁদেরও।
তিনি আবার অলিম্পিকের আন্তর্জাতিক কমিটির প্রথম এশীয় সদস্যও। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত অলিম্পিকের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে জুডোকে অলিম্পিকে জায়গা দেওয়ার প্রস্তাবও এসেছিল। তবে জাপানের বাইরে অন্য দেশগুলিতে জুডোর প্রচলন তখনও সেভাবে শুরু হয়নি। ১৯৬৪ সালের অলিম্পিকে প্রথমবার জায়গা পায় জুডো। কিন্তু সেই ঘটনা দেখে যেতে পারেননি কানো জিগোরো।
আজ কানো জিগোরোর ১৬১ তম জন্মবার্ষিকীর স্মরণে গুগলের জন্য একগুচ্ছ ডুডল এঁকেছেন লস-অ্যাঞ্জেলসের শিল্পী সিনথিয়া ইউয়ান চেং। খুব কম ক্ষেত্রেই একসঙ্গে একাধিক ডুডল প্রকাশ করে গুগল। কানো জিগোরো সেই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিদেরই একজন।
Powered by Froala Editor