২০২৩-এর ২৮ আগস্ট। বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে (World Athletics Championship) প্রথম ভারতীয় হিসাবে সোনা জিতলেন নীরজ চোপড়া (Neeraj Chopra)। তাঁর বর্শা ৮৮.১৭ মিটার দূরে গিয়ে পড়তেই ইতিহাস। দু-বছর আগের কথা। এই আগস্টেই কিন্তু অলিম্পিকে সোনা জয় নীরজের।
২০২১-এর ৭ আগস্ট নীরজের ৮৭.৫৮ মিটারের একটা বিশাল থ্রো অলিম্পিকের ইতিহাসে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে প্রথম সোনা এনে দেয় ভারতকে। নীরজের পদক জেতার কিছুক্ষণ পরেই বেসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য এম সিন্ধিয়ার একটি টুইট। অলিম্পিকে অভিষেকেই স্বর্ণপদক জয়ীকে অভিনন্দন জানিয়ে মন্ত্রী লেখেন, সত্যিকারের মারাঠা তেজ এবং দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন নীরজ। সিন্ধিয়ার এমন পোস্টের পর থেকে নিউজ আউটলেটগুলি, যেমন― মহারাষ্ট্র টাইমস, টিভি ৯ হিন্দি, লোকসত্তা, এবিপি মারাঠি, দৈনিক জাগরণ ইত্যাদি নীরজের ‘কথিত’ মারাঠা বংশ সম্পর্কে রিপোর্ট করে বসে। ৮ আগস্ট, সুদর্শন নিউজের প্রধান সম্পাদক সুরেশ চাভাক্সের দাবি, নীরজের পূর্বপুরুষরা ১৭৬১-র পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সময় মারাঠা সেনাবাহিনীর অধীনে বল্লম বাহিনীর (জ্যাভলিন ব্যাটালিয়ন) অংশ ছিলেন।
নীরজ চোপড়া রোর (উচ্চারণ রাউদ) সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছেন। দ্য প্রিন্ট-এর সূত্রমতে, রোর-মারাঠারা মারাঠা সেনাদের বংশধর। ১৭৬১-র পানিপথের যুদ্ধে এই রোর-মারাঠাদের লড়াই দৃষ্টান্তমূলক। হালফিলে সম্প্রদায়টির লোকসংখ্যা প্রায় ৭ লক্ষ। কার্নাল থেকে রোহতক ও ভিওয়ানি পর্যন্ত তাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। কিন্তু কথা হল, নীরজকে এই মারাঠা বংশ তত্ত্বে মিলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তাঁর পরিবার মেনে নেয়নি। তা-সত্ত্বেও কিন্তু এমন আলোচনার অন্ত হয়নি। বরং তা বহরে বেড়েছে। অল্ট নিউজ রোর সম্প্রদায়ের সদস্য এবং জাগৃতি মঞ্চ পানিপথ-কার্নালের সদস্য রাজেন্দ্র পাওয়ারের সঙ্গে কথাও পর্যন্ত বলে। বেশিরভাগ রোর সম্প্রদায়ের মানুষ যে মারাঠাদের সঙ্গে বংশ ভাগ করার কথা বিশ্বাস করেন, এমনটাই মত ছিল পাওয়ারের। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ভাষাগত ধরন এবং উপাধি মারাঠাদের মতোই ছিল। আমরা সবসময় জানতাম আমরা মারাঠাই। ঐতিহাসিক বসন্তরাও মোরের ‘পানিপথ যুদ্ধ কে রোর মারাঠো কা ইতিহাস’ নামে এক গ্রন্থ প্রকাশ পাওয়ার পর এই তথ্যটি আরও জোরালো হয়। ২০১০-এর পর আমাদের সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন সদস্য তাঁদের সন্তানদের জন্ম শংসাপত্রে মারাঠা লিখতে শুরু করেছিলেন।” মোরের বইয়ের আগে মারাঠা বীরেন্দ্র ভার্মার উদ্যোগে রোর-মারাঠাদের নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করার দায়িত্ব ছিল মারাঠা মিলন সমারোহ-র। এহেন বীরেন্দ্র ভার্মা ২০০৯ এবং ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন।
অখিল ভারতীয় মারাঠা জাগৃতি মঞ্চের জাতীয় সমন্বয়কারী মিলিন্দ পাতিলের মতে, বইটি মারাঠি এবং হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১০-এ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলের উপস্থিতিতে বইটির উদ্বোধন হয়। সেই ছবিও শেয়ার করেছিলেন তিনি। ওই বছরেই কোলহাপুরের শিবাজি বিশ্ববিদ্যালয় মোরের বইয়ের উপর একটি আলোচনাসভা পরিচালনা করে। হরিরাম গুপ্তের ‘Marathas and Panipat’ নামের একটি বইয়ের কথাও জানা যায়। ১৯৬১-তে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় বইটি প্রকাশ করে। পাওয়ার যে ভাষাগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছিলেন, বইটির এক অধ্যায়ের একটি অনুচ্ছেদে রয়েছে সে-সম্পর্কে আলোচনা। রোহতক (হরিয়ানা), মিরাট (উত্তরপ্রদেশ) ইত্যাদি জায়গায় মহিলারা ‘হাউ আয়া, হাউ আয়া’ বলে তাঁদের সন্তানদের ভয় দেখান। বড়দের কথা না শুনলে এই বুলি বলে সন্তানদের ভয় দেখান তাঁরা। বই অনুসারে, এই ক্ষেত্রে ‘হাউ’-এর অর্থ সম্ভবত ‘ভাউ’। যা একটি উপাধিও। পাওয়ার মনে করেন, এটি মারাঠা শিকড়ের প্রমাণ। সদাশিবরাও ভাউয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠা সেনাবাহিনীর সর্দার-সেনাপতি হিসাবে কাজ করেছিলেন। এই তথ্যগুলি নেতৃস্থানীয় মারাঠা পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে নেওয়া। নথির পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩৫১। সাক্ষাৎকার যাঁরা দিয়েছিলেন, তাঁদের নাম ৩৬৩ পৃষ্ঠায় তালিকাভুক্ত। নীরজ চোপড়া বা তাঁর বাবার জন্মগত উপাধির সঙ্গেও তার কোনও মিল পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন
লরিয়াস স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড ব্রেকথ্রু সম্মানের জন্য প্রথম ভারতীয় হিসাবে মনোনয়ন নীরজ চোপড়ার
অল্ট নিউজ রোর সম্প্রদায়ের অন্য এক সদস্য এবং ‘উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে আধুনিক সিন্ধু উপত্যকার জনসংখ্যার জেনেটিক অ্যানসেস্ট্রি’ বিষয়ে গবেষণা করা অনুরাগ কাদিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছিল। অনুরাগ নিশ্চিত যে, মারাঠাদের সঙ্গে রোরদের সাম্প্রতিক কোনও ঐতিহাসিক যোগসূত্র নেই। অনুরাগ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজি এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র। তাঁর কথায়, ‘আমি এই বিষয়টি অধ্যয়ন করেছি। এই বিষয়ে আমাদের জনসংখ্যার জেনেটিক্স অধ্যয়ন সবচেয়ে আগে দরকার। অনুসন্ধান করে পেয়েছি, গত ১৮০০ বছরে মারাঠা সম্প্রদায়ের সঙ্গে রোরদের সাম্প্রতিক কোনও ঐতিহাসিক যোগসূত্র নেই।’ যাঁরা ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে কাদিয়ানের অনুসন্ধানের বিষয়ে আগ্রহী, তাঁরা এই টুইট থ্রেডটি দেখতে পারেন। আরও একটি যুক্তি, কিছু রোর গ্রাম পানিপথের যুদ্ধের অনেক আগেকার। এছাড়াও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাইটোজেনেটিক্স ল্যাবের অধ্যাপক এবং গবেষক-লেখক জ্ঞানেশ্বর চৌবে বলছেন, ‘আমাদের গবেষণায় অন্তত গত ১,৫০০ বছর ধরে মারাঠা সম্প্রদায়ের সঙ্গে রোর সম্প্রদায়ের সাম্প্রতিক বংশের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।’
আরও পড়ুন
ওজন কমাতে শুরু খেলাধুলা, জ্যাভলিন ভারতের নতুন তারকা নীরজ
অল্ট নিউজ নীরজ চোপড়ার ম্যানেজার আমান শাহের কাছেও পৌঁছয়। তাঁর দৌলতেই নীরজের দাদা ধরমসিংহ চোপড়া এবং তাঁর কাকা সুরেন্দ্র কুমারের কাছে যায় সংবাদমাধ্যমটি। নীরজ তাঁদের সঙ্গে হরিয়ানার পানিপথ জেলার খান্দ্রা গ্রামে যৌথ পরিবারে থাকেন। সুরেন্দ্র বলেন, ‘নীরজের এই কৃতিত্বকে জাতপাত ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়। তিনি একজন ভারতীয় হিসেবে পদক জিতেছেন। আমরা হরিয়ানার রোর সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। এই সম্প্রদায়ের একটি অংশ বিশ্বাস করে, তাদের মারাঠা বংশ রয়েছে। যাই হোক, আমরা-সহ বেশিরভাগ রোর তা বিশ্বাস করেন না।’ ধরমবীর বলেন, ‘আমার বাবা এবং দাদার সঙ্গে আমার শৈশব কাটিয়েছি। তাঁরা দু-জনই কৃষক ছিলেন। কেউ বলেননি আমাদের বংশ মারাঠা।’
সুরেন্দ্র আরও বলেন, “দু-দশক আগে পর্যন্ত মারাঠা রোরদের ঘটনা এতটা জনপ্রিয় ছিল না। তবে কয়েক বছর ধরে এটি জনপ্রিয় হয়েছে ভোটের রাজনীতির কারণে। আমাদের রোর-মারাঠা বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানানোর সময় আমরা তাঁদের ‘মারাঠা’ বলে সম্বোধন করি। কারণ আমরা তাদের বিশ্বাসকে সম্মান করি। তাঁরাও আমাদের অনুভূতিকে সম্মান করে একই কাজ করে। তবুও রোর-মারাঠা সম্প্রদায়ের কিছু রোররা মারাঠা বংশকে আলিঙ্গন করার ব্যাপারে জোর দেন। তবে আমরা মারাঠা নয়, নিজেদের রোর হিসাবে চিহ্নিত করি।” সব শেষে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, ১২ আগস্ট মারাঠা জাগৃতি মঞ্চ পানিপথ-কার্নালের সদস্যরা শুভেচ্ছা জানাতে নীরজের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের হাতে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ এবং নীরজের ছবি-সহ একটি ফোটো ফ্রেম। যা উপহারস্বরূপ ‘সোনার ছেলে’র পরিবারকে দিয়েছিলেন তাঁরা। দেশকে যিনি অলিম্পিকে সোনা এনে দিয়ে গর্বিত করলেন, তাঁর পরিবার জাতির দেখানো সমস্ত সমর্থন এবং ভালোবাসাকে সাদরে গ্রহণ করে। তবে নীরজের জয়ে জাতপাতের আখ্যান না ওঠাই ভালো। এতে ‘বীররস’ কোনও অর্থে কমে না।
Powered by Froala Editor