লোকটি এমনিতে নিরীহ গোছের। বীমা কোম্পানির সেলসের কাজ করে জীবন চালান। দোষের মধ্যে একটাই, কালো চামড়ার মানুষ দেখলেই সহ্য করতে পারেন না। তাও যদিবা ক্রীতদাসের মতো থাকে, মেনে নেওয়া যায়। তারাই আবার আমেরিকার বুকে সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকারও দাবি করছে! কিন্তু সেই মানুষটিই একদিন সকালে উঠে দেখলেন তাঁর গায়ের রং বদলে গিয়েছে পুরোপুরি। ‘নিগ্রো’-দের সঙ্গে তাঁর আর কোনো পার্থক্যই নেই।
১৯৭০ সালে হলিউডে মুক্তি পেল কমেডি সিনেমা ওয়াটারমেলন ম্যান। আর সেখানে এভাবেই বর্ণবৈষম্যকে আঘাত করলেন পরিচালক মেলভিন ভ্যান পিবলস (Melvin Van Peebles)। তিনি ‘গডফাদার অফ ব্ল্যাক সিনেমা’ (Godfather of Black Cinema) নামেও পরিচিত। ১৯৩২ সালে শিকাগো শহরের এক দর্জির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ভ্যান পিবলস। সিনেমা কাকে বলে, তা নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। রোজগারের আশায় প্রথমে একটি টুরিস্ট সংস্থায় কেবল কার গ্রিপম্যানের কাজ শুরু করেন তিনি। এই সময় নিজের আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও লিখতে থাকেন। তবে সেইসব লেখাও যে ছাপা হতে পারে, এমনটা ভাবেননি কোনোদিন। তাঁর প্রথম বই ‘দ্য বিগ হার্ট’ যখন বেশ জনপ্রিয়তা পেল, তখনই এক টুরিস্ট তাঁকে পরামর্শ দিলেন সিনেমা বানানোর জন্য।
সিনেমা বানানোর পরামর্শ তো বেশ ভালোই লাগল পিবলসের। কিন্তু কীভাবে বানাতে হয় সিনেমা? কিছুই তিনি জানেন না। এটুকু জানেন, সিনেমা বানাতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন একটা ক্যামেরার। নিজের সঞ্চয় বলতে তখন মাত্র ৫০০ ডলার। সেখান থেকেই কিছুটা নিয়ে একটা সস্তা ক্যামেরা কিনে ফেললেন। আসলে সিনেমা বানানোর জন্য যে বিভিন্ন কোম্পানি লগ্নি করে, প্রযোজকদের কাছে যাওয়া যায়, এসব কিছুই জানতেন না পিবলস। ১৯৫৭ সালে ‘পিক-আপ মেন ফর হ্যারিক’ দিয়ে শুরু। এরপর বেশ কয়েকটা শর্ট ফিল্ম বানালেন। পরে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, শর্ট ফিল্ম আর ফিচার ফিল্মের পার্থক্যও তখনও তিনি জানতেন না। শুধু জানতেন ১১ মিনিটের বেশি দৈর্ঘ্যের সিনেমা বানানোর মতো অর্থ তাঁর নেই।
বলিউডের পর্দায় পিবলসের প্রথম আত্মপ্রকাশ কমেডি সিনেমা ‘ওয়াটারমেলন ম্যান’ দিয়ে। ১৯৭০ সালে কলোম্বিয়া পিকচার্সের প্রযোজনায় মুক্তি পায় পূর্ণদৈর্ঘ্যের এই ছবিটি। এরপরের বছরেই মুক্তি পেল ‘সুইট সুইটব্যাকস বদাস সং’। এই সিনেমার প্রযোজক পিবলস নিজেই। কোনো নামকরা চলচ্চিত্র নির্মাতা কোম্পানির ট্যাগ নেই। তবুও আমেরিকাজুড়ে যেন ঝড় তুলে দিয়েছিল সিনেমাটি। এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উপার্জন করা স্বাধীন চলচ্চিত্র এটি। এরপর একে একে মুক্তি পেল ‘ডোন্ট প্লে আস চিপ’, ‘দ্য সফেস্টিকেটেড জেনটস’, ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’, ‘প্যান্থার’-এর মতো সিনেমা। সময়টাই তখন বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে উত্তাল আন্দোলনের।
আরও পড়ুন
জার্মানির ডক-লিপজিগ তালিকায় কালীঘাটের যৌনপল্লি নিয়ে তৈরি সিনেমা
শুধুই সিনেমার পরিচালনা নয়। একের পর এক সিনেমার প্রযোজনাও করেছেন তিনি। বহু সিনেমা রাজনৈতিক কারণে মুক্তি পায়নি। তবুও দমে যাননি পিবলস। আবার নতুন করে শুরু করেছেন কাজ। সিনেমার পাশাপাশি নাটকের মঞ্চেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। কয়েকটা চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন নিজে। শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই তাঁর একমাত্র কর্তব্য বলে মনে করতেন পিবলস। আর এই কারণেই কোনোরকম সাংগঠনিক যোগাযোগ ছাড়াই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ আন্দোলনের অন্যতম মুখ। এরপর আমেরিকার বাস্তবতা বদলেছে। ২০০৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন বারাক ওবামা। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের কাছে সে এক স্মরণীয় মুহূর্ত। কিন্তু এরপরেও সামাজিকভাবে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইটা বাকি থেকেই গিয়েছিল। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল সেই সত্য। আবারও বর্ণবিদ্বেরষের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠল আমেরিকা। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছে গেল ইউরোপ সহ পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে। আর ঠিক সেই সময়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন মেলভিন ভ্যান পিবলস।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্রের বাড়িতে ব্লু প্লেক, তৈরি হবে প্রদর্শনশালাও
গত মঙ্গলবার ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যু হল ভ্যান পিবলের। পিবলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হলিউডের একটি যুগের অবসান হল।
আরও পড়ুন
প্রসঙ্গ ‘RAY’ : সাহিত্যের ভাষাকে সিনেমায় হুবহু দেখানোর দায় নেই পরিচালকের
Powered by Froala Editor