হারিয়ে যাচ্ছে চারপাশের পতঙ্গের দল, বিগত ৩০ বছরে লুপ্ত এক-চতুর্থাংশ

আজকের আধুনিক শহরগুলো গড়ে ওঠার অনেক আগে গ্রামগঞ্জের চেহারাটাই ছিল যেন সম্পূর্ণ অন্যরকম। বৈদ্যুতিক আলোর এই রোশনাই ছিল না। সন্ধে হলেই অন্ধকার এসে গ্রাস করত সবকিছু। আর ফাঁকা মাঠে ডেকে উঠত ঝিঁঝিঁ পোকা। সেসব ডাক এখন আর শুনতে পাওয়া যায় না। আরও কত ধরনের পোকার কথা শোনা যায়। কাঁচ পোকা, আলতা পোকা, সিঁদুর পোকা…

এখনও অনেক মানুষ আছেন যাঁরা ছোটোবেলায় সেসব পোকা দেখেছেন। এই তো, কিছুদিন আগেও দীপাবলির রাতে প্রদীপের আশেপাশে ঘুরে বেড়াত শ্যামা পোকা। তাদেরও আর দেখতে পাওয়া যায় না। একে একে সবাই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীর আবির্ভাবের বহু আগে থেকে যারা পৃথিবীতে বসবাস করছে, নয় নয় করে কয়েক লক্ষ বছর কাটিয়ে দিয়েছ এই পৃথিবীতে, তাদের বিলুপ্ত হয়ে যেতে লেগেছে মাত্র কয়েক দশক। এইসব ছোট্ট পতঙ্গদের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা হয়তো আমরা খেয়াল করেই দেখিনি। পতঙ্গ গোত্রের প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও তো তেমন নিকট নয়। নয় কী? এই প্রশ্নটাই উস্কে দিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানেই নানা প্রজাতির পতঙ্গের বাস। নির্দিষ্ট অঞ্চলের জলবায়ুর মতো পতঙ্গদের বৈচিত্র্যও বিপুল। তবে তার উপযুক্ত কোনো রেকর্ড তৈরি করা মুশকিল। ইউরোপ আমেরিকার পতঙ্গদের নিয়ে খানিকটা গবেষণা হয়েছে। তবে এশিয়া, আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের অসংখ্য পতঙ্গ থেকে গিয়েছে অগোচরে। অথচ মানুষের জীবনে পতঙ্গদের প্রভাব ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ফসলি উদ্ভিদের পরাগসংযোগের কাজটাই করে এরা। কিন্তু তাদের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আমরা কতটুকুই বা বিচলিত?

তবে বিজ্ঞানীদের কাছে বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নানা ধরনের গবেষণাও চলেছে এই নিয়ে। সম্প্রতি জার্নাল সায়েন্স পত্রিকায় তেমনই একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপের একদল বিজ্ঞানী পৃথিবীর মোট ১৭০০টি স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন, বিগত তিন দশকে পৃথিবীর বুকের থেকে অন্তত ২৪ শতাংশ পতঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ ৩০ বছর আগে যতগুলি প্রজাতি ছিল, তার এক চতুর্থাংশের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বছর পাঁচেক আগে প্রায় অনুরূপ একটি গবেষণাতেও উঠে এসেছিল এই তথ্য। তবে সেক্ষেত্রে খুব অল্প পরিসরে সমীক্ষা করা হয়েছিল। বৃহৎ পরিসরে গবেষণা করেও দেখা গেল, ফলাফল মোটের উপর একই। আর এর ফলে জঙ্গলের স্বাভাবিক উদ্ভিদের জীবন যেমন বিপন্ন হবে, তেমনই বিপন্ন হবে কৃষিজ ফসলের উৎপাদনও। ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় এই ঘটনার ছাপ পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না।

বিগত ৩০ বছরেই এই বিপুল সংখ্যক পতঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তার আগে সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে আরও বেশি ছিল। অবশ্য তার সঠিক কোনো তথ্য আর পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কেন হারিয়ে যাচ্ছে এই পতঙ্গরা? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর জন্য দায়ী বদলে যাওয়া পরিবেশ। ফসল রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে প্রাণ সংকটে পড়েছে বহু পতঙ্গ। তাছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ আজকের মানুষের জীবনযাত্রা। পতঙ্গদের চোখের গঠন একটু অন্যরকম। খুব বেশি আলো সহ্য করতে পারে না বেশিরভাগ পোকা। তাই নগরকেন্দ্রিক মানুষের জীবনকে ঘিরে থাকা বৈদ্যুতিক আলো পতঙ্গদের বিলুপ্তির অন্যতম বড় কারন। আলোর অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারকেও একধরনের দূষণ বলে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধি, এসবও সংকটের অন্যতম কারণ হয়ে থাকতে পারে।

মানুষের তুলনায় আকারে রীতিমতো ছোট এইসব পোকা। অনেক পোকাকে তো খালি চোখে দেখতেও পাওয়া যায় না। ফলে মানুষের মনোযোগ তাদের দিকে ফিরেছে অনেক দেরিতে। ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার প্রায় হয়ে গিয়েছে। তবে মানুষকে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে পতঙ্গদের বেঁচে থাকাও যে জরুরি। এখন আর তাদের বাঁচানোর কোনো পথ আছে কি? বিজ্ঞানীদের কাছে এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তবে সেই উপায় খুঁজে পাওয়ার পরেও, আমরা কি এইসব ছোট্ট প্রাণীদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারব আজও? এই প্রশ্নটাও থেকে যায় স্বাভাবিকভাবেই।