হাতের লেখা খারাপ; গিরিশ ঘোষের ‘গণেশ’দলে ছিলেন বিখ্যাতরাও

মহাভারত কী করে লেখা হয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই মনে আছে। না থাকলে আরেকবার মনে করে নেওয়া যাক। বেদব্যাস ঠিক করেছেন, ‘অমৃত কথা’ মহাভারত রচনা করবেন তিনি। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। আর তখনই ঠিক হল, সিদ্ধিদাতা গণেশ এসে রচনার কাজে সাহায্য করবেন। কেমন করে? বেদব্যাস মুখে মুখে শ্লোকগুলি রচনা করে যাবেন; আর পাশে বসে গণেশ সেই শ্লোক লিপিবদ্ধ করে যাবেন। এইভাবেই পুরো বিষয়টি সম্পূর্ণ হয়েছিল।

কিন্তু এর সঙ্গে আজকের বিষয়ের কী মিল? অবশ্যই মিল আছে। বলা ভালো ষোলো আনাই মিল পাবেন আপনি। তবে এখানে আসল চরিত্রটি বেদব্যাস নন, গিরিশচন্দ্র ঘোষ (Girish Ghosh)। বাংলার নটসম্রাট। তাঁর হত দিয়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চ দেখেছে বিপ্লব। একের পর এক নাটকে তৈরি করেছেন ইতিহাস। আর সেরকমই ছিল তাঁর প্রতিভা। তবে এখানেই থেমে নেই বিষয়টা। নিজের জীবনকালে এত এত নাটক লিখেছেন, চিঠিও লিখেছেন; তার কোনোটাই কিন্তু নিজে হাতে ধরে লেখেননি। তার মানে? অন্য কেউ লিখে দিয়েছে? 

প্রকারান্তরে, তাইই। তবে ঘাবড়াবেন না। মৌলিক সৃষ্টি গিরিশ ঘোষেরই; শুধু হাতের লেখাটি অন্য কারোর। ঠিক ওই বেদব্যাস-গণেশের মতো। গিরিশ ঘোষের নিজের হাতের লেখা একদমই ভালো ছিল না। আর এই ব্যাপারটি তিনি নিজেও জানতেন দিব্যি। যখন নাটক লিখছেন বা চিঠি লিখছেন; তখন তো ব্যাপারটি আর নিজের থাকছে না। অন্যরাও সেটা পড়বে। আর এখানেই হাতের লেখার জন্য বেজায় অসুবিধার মুখে পড়তে হত বাকিদের। সেই ব্যাপারটি থেকে রেহাই দিতেই গিরিশ ঘোষের জীবনে ‘গণেশ’-এর আগমন। তিনি স্রেফ মুখে মুখে বলতেন, আর পাশে থাকা মানুষটি খসখস করে লিখে যেতেন সেটা। ব্যস, সমস্যার সমাধান! 

তবে গল্প এখানেই শেষ হয়নি। গিরিশ ঘোষ তো একা নন; এর আগে নবীনচন্দ্র সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তও তো এই পন্থা নিয়েছেন। কিন্তু গিরিশ ঘোষ আলাদা কোথায়? তাঁর অবিশ্বাস্য প্রতিভার কাছে। এই অনুলেখকদের (Copyist) নিয়েই নানা ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে গিরিশবাবুর জীবনে। আজ্ঞে হ্যাঁ, বহুবচন ইচ্ছে করেই ব্যবহার করা হল। কারণ একজন নন, বেশ কয়েকজন এই ‘গণেশ’ হবার দায়িত্বটি নিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিলেন অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র, কেদারনাথ চৌধুরী, অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়দের মতো মানুষেরা। আর এই কাজ করতে গিয়েই তাঁরা বারবার সাক্ষী থেকেছেন গিরিশ ঘোষের প্রতিভার… 

আরও পড়ুন
‘এসবই ওঁর বুজরুকি’ – রামকৃষ্ণকে প্রথমবার দেখে বলেছিলেন গিরিশ ঘোষ

নাটক লেখার সময় গিরিশবাবুর একটি নির্দিষ্ট পন্থা ছিল। প্রায় সব সময়ই যেন তাঁর মাথায় ঘোরাফেরা করত শব্দেরা। শুধু নাটকের প্রথম দুটো অঙ্ক তৈরি করতেই যা সময় নিতেন; একবার মাথায় চলে এলে তারপর যেন রেলগাড়ির গতিবেগে পুরোটা সামনে চলে আসত। গিরিশ ঘোষ তো তন্ময় হয়ে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছেন সবটা। এদিকে বিপদে পড়তেন তাঁর অনুলেখকরা। মাঝখানে যদি কিছু বাদ যেত, জিজ্ঞেস করতেও ভয় পেতেন। কারণ, গিরিশ তো একেবারে প্লটের ভেতরে ঢুকে গেছেন! সেখানে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া মানে তাঁর চিন্তাভাবনার স্রোতেই ধাক্কা খাবে। সেটা তো হতে দেওয়া যায় না। তবুও যারা প্রথম প্রথম অনুলিখনের কাজে আসতেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর বকাঝকা খেয়েছেন। 

আরও পড়ুন
চাইলে শেক্সপিয়রও নিউটন হতে পারেন, অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিলেন মাইকেল মধুসূদন

যখন নাটক লেখা চলত, তখন দিন-রাতের ঠিক থাকত না। এমনকি, নাটকে অভিনয় করতে করতেও নতুন নাটক তৈরি করতেন গিরিশ ঘোষ! তখন ‘সীতারাম’ আর ‘প্রফুল্ল’— দুটি নাটকে চুটিয়ে অভিনয় করছেন গিরিশ। এমন সময় হাজির হলেন মিনার্ভা থিয়েটারের নরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব। কী ফরমায়েশ? সেরকম কিছুই না; গিরিশবাবুর একটা পুরনো নাটকে ছোট্ট একটু গীতিনাট্য ঢুকিয়ে দিলে ভালো হত। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে মাথার কলকব্জা নড়ে উঠল। গিরিশ ঘোষের সঙ্গে প্রায় সবসময়ই থাকতেন একজন করে অনুলেখক। বলা যায় না, কখন কী চলে আসে মাথায়। 

আরও পড়ুন
যেখানে ঘুমোচ্ছেন মধুসূদন, মৃতদেহে ছায়া দিচ্ছে পরী, কলকাতার হারানো অতীত ও এক কবরস্থান

তখন নাটক করতে করতেই ওই পুরো অংশটি লেখা হয়ে গেল। গিরিশবাবু একবার করে স্টেজে যাচ্ছেন; অভিনয়ের ফাঁকে বাইরে এসে একটু করে বলে যাচ্ছেন। তাহলে! এমনি এমনি কি গিরিশ ঘোষ বাংলার নটসম্রাট! তবে সবার কাছে আবার ধমকধামক চলত না বেশি। যেমন দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার। দুজনেই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পরমভক্ত। দেবেন্দ্রনাথকে এতটাই শ্রদ্ধা করতেন গিরিশ, যে চাইলেও ধমক দিতে পারতেন না তাঁকে। বরং উল্টোটাই কিছুক্ষেত্রে হত। তবে আখেরে যে সবদিক থেকেই লাভ হত, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না… 

তথ্যসূত্র- ‘কলির শহর কলকাতা’ / হরিপদ ভৌমিক 

Powered by Froala Editor

More From Author See More