চারদিকে রঙিন ফুল। ইতিউতি চেয়ে আছে কাঠের সেতুরা। পাখিরা ডাকছে। হাঁসেরা খেলছে খালের স্বচ্ছ জলে। টাটকা হাওয়ায় চামর দোলানো গাছ জানান দিচ্ছে এই গ্রামে বারোমাস 'বসন্ত'। নেদারল্যান্ডসের ওভারিজসেল ডাচ প্রদেশের এই গ্রামের নাম গিথোর্ন (Giethoorn)। সে রাস্তাবিহীন। হ্যাঁ, ঠিক শুনছেন। কোনো রাস্তা নেই গিথোর্নে।
সম্পূর্ণভাবে গাড়ি-মুক্ত এই গ্রাম চার মাইলেরও বেশি খাল দিয়ে ঘেরা। এখানে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। গিথোর্নকে ডাকা হয় 'ডাচ ভেনিস'। এখানকার প্রকৃতি সপ্রতিভ। নিস্তব্ধতা গ্রামের মেঠো পথের গয়না।
স্বচ্ছ খাল, রঙিন ফুল এবং কাঠের সেতুর জন্য পরিচিত গিথোর্ন। রাস্তাবিহীন এই গ্রামে স্থানীয়রা ঘুরে বেড়াতে ব্যবহার করেন পান্ট (নৌকাবিশেষ)। গ্রামের উপকণ্ঠে গাড়ি পার্কের জায়গা। কায়াক বা হুইসপার বোটও পরিবহণের মাধ্যম। হুইসপার বোটের মোটর বিশ্রী শব্দ করে শান্তিকে ব্যাহত করে না। সে-কারণেই অমন নামকরণ। প্রায় দেড় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমস্টারডাম শহর থেকে ৫৫ মাইল দূরে এখানে আসা যায়। গ্রামের ঢোকা আগে গাড়ি পার্ক করতেই হবে। গিথোর্নে ঘুরে বেড়ানোর আরো একটি হালকা ওজনের সরু জলযান ক্যানো। তবে পরিবহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় পান্ট।
গ্রামের কাছাকাছি ডি উইরিবেন-উইডেন ন্যাশনাল পার্ক। বন্যপ্রাণী উৎসাহীরা এখানে ভোঁদড়, কালো পানচিল, বড় পানকৌড়িসহ দেখতে পাবেন নানান প্রজাতির বক। ত্রয়োদশ শতকে ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসীরা প্রথম এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের উদ্যোগ্যেই পিট বা ঘাসের চাপড়া পরিবহণের জন্য খাল খনন। যদিও কথিত আছে, গ্রামটির আসল বসতিকারীরা কৃষক। তাঁদের ১১৭০ সালের বন্যায় মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে বুনো ছাগলের কিছু শিং এই অঞ্চল থেকে আবিষ্কার হয়েছিল। আদি বাসিন্দা যে কৃষকরাই, এর সপক্ষে যুক্তি এই আবিষ্কার।
আরও পড়ুন
মানুষের অভাব মেটায় পুতুল, কোথায় রয়েছে এই আশ্চর্য গ্রাম?
১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় ডাচ চলচ্চিত্র নির্মাতা বার্ট হ্যানস্ট্রা নির্মিত 'ফ্যানফেয়ার'। এর পরেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ এই ডাচ গ্রামের। অনেকের আদরের ডাকে গিথোর্ন 'লিটল ভেনিস'। আবার কেউ ডাকেন 'উত্তরের ভেনিস'। স্টেনউইজক শহরের প্রায় পাঁচ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমের এই গ্রাম এখন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ১৮০টিরও বেশি সেতু হালফিলের গিথোর্নের ভূষণ।
আরও পড়ুন
ছত্তিশগড়ের এই গ্রামে ঘড়ির ঘোরে উল্টোদিকে!
তিন হাজার জনেরও কম মানুষের বাস গিথোর্নে। গ্রামটির অনেক বাসিন্দারই ঘর ব্যক্তিগত কোনো দ্বীপে। রাস্তা নেই; অগত্যা তাঁরা একে অপরের বাড়ি যান কাঠের তৈরি অপূর্ব কোনো সেতু বা জলযানে খাল পেরিয়ে। সড়ক-ছিন্ন গিথোর্ন নেদারল্যান্ডের অন্যতম প্রধান টুরিস্ট স্পট। পর্যটকদের কাছে গিথোর্ন যেন রূপকথার কোনো গল্প থেকে বেরিয়ে আসা। সুন্দর কাঠের সেতুর পটভূমিতে জলছবির মতো লেপ্টে থাকা গাছের ছায়ায় বসে থাকা যায় সৌরবর্ষ। অখণ্ড অবসর যাপনে কোনো যানবাহনের হল্লা নীরবতা ভাঙাবে না কখনোই।
গিথোর্ন গ্রামে রয়েছে খড়ের ছাউনির ঘরও। প্রত্যেক বাড়িতেই জমকালো বাগান। অমায়িক নিবাসীরাই মালি। খানিক দূরে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কোনো ক্যাফে। খালের ধারের রেস্তরাঁগুলিও নয়নাভিরাম, টিপটপ। স্থানীয় খাবারের মধ্যে ক্র্যাব উইথ লেটুস, স্মোকড স্যামন, ওয়স্টার্স উইথ গিজ্ঞের, লাসাগনা উইথ লবস্টার ইত্যাদি জনপ্রিয়।
গ্রামে কিন্তু সাইকেল লেনও রয়েছে। পর্যটকরা সাইকেল ভাড়া করেও এই ডাচ পল্লী ঘুরে দেখেন। পায়ে হেঁটেও ঘোরা যায়। পথিমধ্যে বিখ্যাত এক জাদুঘর 'হেত ওল্ডে মাত উস' (Het Olde Maat Uus)। মিউজিয়ামে গেলে বোঝা যায়, এখানকার সাধারণ খামারবাড়ি শতাব্দী আগে কেমন ছিল। শিলা নিয়ে যাঁদের আগ্রহ, তাঁদের তালিকায় অবশ্যই থাকবে এই জাদুঘর। নানান বৈচিত্র্যের শিলা জাদুঘরটির শোভা বাড়িয়েছে। গ্রামজুড়ে আয়োজিত হয় শিল্প প্রদর্শনী। শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যক্রমও উল্লেখযোগ্য। গিথোর্নে ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ভবন, দুর্গ এবং গির্জাও।
আইস স্কেটিং উৎসাহীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় গিথোর্ন। তাঁদের কাছে শীতকালীন ছুটির গন্তব্য এই গ্রাম। প্রকৃতির ইচ্ছায় তৈরি বিশাল কোনো জমি স্কেটিংয়ের জন্য সংরক্ষিত। শীতে বরফ পড়ে সবুজ বনানী সফেদ হয়ে যায়। তখন অনেকেই আসেন আইস স্কেটিংয়ের মজা নিতে। নেদারল্যান্ডস এমন একটা দেশ, যারা বর্তমানে স্ব-চালিত গাড়ির দৌড়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তারা সমস্ত নতুন গাড়ি গ্যাস নির্গমন-মুক্ত (ইমিশন-মুক্ত) করার পরিকল্পনা করছে। বিশ্বের প্রথম বায়োডিগ্রেডেবল গাড়িও তৈরির ক্ষেত্রেও ওলন্দাজরা প্রথম। গাড়ির মালিকানা মাথাপিছু মাত্র ০.৫২ গাড়ি রয়েছে দেশটিতে। আর অদ্ভুত এই ডাচ গ্রাম গিথোর্নে কোনো গাড়ি নেই। রাস্তা নেই। দূষণ নেই।
Powered by Froala Editor