সারা গুহায় ছড়িয়ে স্ফটিকের স্তম্ভ, মেক্সিকোতেই রয়েছে সাক্ষাৎ ‘চাঁদের পাহাড়’

নির্জন জঙ্গলের মাঝে দু’দণ্ড বিশ্রাম নিতে গিয়ে এক বিশাল গুহামুখের সন্ধান পেয়েছিল শঙ্কর। না, সেই গুহা তার গন্তব্য নয়। তবুও কৌতূহলবসতই সেই গুহায় প্রবেশ করেছিল দামাল বঙ্গতনয়। আশাহত করেনি প্রকৃতি। সে-গুহার ভেতরকার দৃশ্য চমকে দেওয়ার মতোই। গুহার দেওয়ালে জমে রয়েছে সাদা নুনের মতো চকচকে স্ফটিকের আস্তরণ। ছাদ থেকে বটের ঝুরির মতো নেমে এসেছে স্বচ্ছ কেলাসের স্তম্ভ। মেঝেতেও ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে সেসব পাথর। শঙ্করের বুঝতে অসুবিধা হয়নি আদতে সেগুলি মহামূল্যবান হীরকখণ্ড। 

নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না, এই দৃশ্য বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’-এর। আফ্রিকায় সত্যিই এমন কোনো জায়গা আছে কিনা, জানা নেই। তবে মেক্সিকোর (Mexico) ‘লা কুয়েভা ডে লস ক্রিস্টালস’ বা জায়েন্ট ক্রিস্টাল কেভ-এ (Giant Crystal Cave) পৌঁছালে মনে হবে যেন এসে হাজির হয়েছেন চাঁদের পাহাড়ের সেই প্রেক্ষাপটেই। তার চরিত্র হুবহু মিলে যায় চাঁদের পাহাড়ের বর্ণনার সঙ্গে। 

আজ থেকে মাত্র বছর কুড়ি আগের কথা। ২০০০ সাল। মেক্সিকোর নেইকা খনিতে তখন পুরোদমে কাজ চলছে সোনা, রুপো এবং জিঙ্ক খননের। সেই সময় সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়েই হঠাৎ মাটির তলায় এক অজানা প্রাকৃতিক কক্ষের সন্ধান পান দুই মেক্সিকান ভাই হুয়ান ও পেদ্রো। আরেকটু খনন করার পরেই বেরিয়ে আসে প্রকাণ্ড স্ফটিকের ভাণ্ডার। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই খনির ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার বন্ধ করে দেন খননের কাজ। শুরু হয় গবেষণা। 

রাত-দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও যাদের দু’বেলা ভাত জোটাতে কালঘাম ছোটে, তাঁদের কি আটকানো যায় এমন রত্নভাণ্ডারে অনুপ্রবেশ করা থেকে? কাজ বন্ধ করেও ঠেকানো যায়নি গুহায় শ্রমিকদের অনুপ্রবেশ। হীরক ভেবেই সেই স্ফটিক সংগ্রহ করতে রীতিমতো হিড়িক পড়ে যায় তাঁদের মধ্যে। এরই মধ্যে ঘটে যায় একটা অঘটন। অক্সিজেনের অভাবে প্রাণ হারান এক শ্রমিক। ভূগর্ভস্থ তাপে প্রায় ঝলসে যায় তাঁর দেহ। তারপরেই এই গুহার প্রবেশমুখে সেনা মোতায়েন করে মেক্সিকান সরকার। 

কিন্তু এসব প্রস্তরখণ্ড সত্যিই কি হীরে? না, ভূতাত্ত্বিকরা জানাচ্ছেন দুধ-সাদা এই স্ফটিক মূলত সেলেনাইটের। যা মূলত জিপসাম থেকেই তৈরি। প্রাচীন কালে এই গুহার মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হত জলের ধারা। পরবর্তীতে জেগে ওঠে পাহাড়ের তলায় ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি। ম্যাগমার উত্তাপেই ক্রমশ জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে জিপসাম বদলে যায় সেলেনাইটে। আরও পরে আগ্নেয়পাথরের স্তরে চাপা পরে যায় গোটা ‘কক্ষ’-টি। গবেষকদের অনুমান এসব স্ফটিকস্তম্ভের বয়স ৫ লক্ষ বছরেরও বেশি। 

ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৯০ মিটার গভীরে থাকা আশ্বক্ষুরাকৃতি গুহাটির আয়তন প্রায় তিন হাজার বর্গফুট। তলায় ম্যাগমার ভাণ্ডার থাকায় গুহার গড় উষ্ণতা ঘোরাফেরা করে ৫৮-৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। বায়ুর আর্দ্রতাও প্রায় ৯৯ শতাংশ। সেইসঙ্গে আলোর অভাব এবং অম্লতা আরও প্রাণঘাতী করে তোলে অপার্থিব সুন্দর এই গুহাকে। কিন্তু এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার কি কোনো সুযোগই নেই?

আছে বৈকি! তা না হলে কীভাবেই বা সামনে এল এইসব রহস্যভাণ্ডার? দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী বিশেষ পোশাক রবারের গ্লাভস, জুতো এবং অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে পাড়ি জমানো যায় এই গুহার ভেতরে। তবে তারপরেও মাত্র ৪৫ মিনিট সময় কাটানো যায় গুহার ভেতরে। সময়সীমা অতিক্রম করলেই অনিবার্য মৃত্যু। তাছাড়াও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং মেক্সিকো সরকারের থেকে প্রবেশাধিকার জোগাড় করাও বেশ দুরূহ কাজ পর্যটকদের কাছে। কী ভাবছেন? ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণে গেলে একবার ঢুঁ মেরে আসবেন নাকি ‘ভয়ানক’ সুন্দর এই গুহায়?

Powered by Froala Editor