মরুভূমির ওপরে ছোট্ট একটা লোকালয়। তার চারিদিকে সুবিশাল উঁচু পাথরের প্রাচীর। বিশাল লাল পাথরের প্রবেশদ্বার। শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িগুলো এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে। মন্দিরে এখনও সাজানো রয়েছে দেব-দেবীদের বিগ্রহ। কিন্তু প্রাণের স্পন্দন নেই কোনো। গোটা শহরটাই যেন সাক্ষাৎ এক মৃত্যুপুরী। মাত্র এক রাতের মধ্যেই হঠাৎ জনশূন্য হয়ে পড়েছিল গোটা শহরটা। না, ভিনদেশের কথা হচ্ছে না। এমনই এক ছবির মতো সাজানো শহর রয়েছে ভারতেই। রাজস্থানের জয়সালমির থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত এই শহর। নাম, কুলধারা। বর্তমানে কুলধারা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে পরিচিত ভৌতিক শহর হিসাবেই।
১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ঐতিহাসিক লক্ষ্মী চাঁদের গ্রন্থ ‘তারেখ-ই-জয়সালমির’ থেকে জানা যায় এই শহরের জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে। যোধপুরের পালি অঞ্চলে বসবাসকারী পালিওয়াল সম্প্রদায়ের এক ব্রাহ্মণ প্রথম বসতিস্থাপন করেছিলেন এই অঞ্চলে। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আস্ত একটি জনপদ। বাসিন্দাদের সকলেই কুলধার গোত্রের মানুষ হওয়ায়, শহরটির নাম হয়ে ওঠে কুলধারা। বাণিজ্য এবং কৃষি— উভয়ক্ষেত্রেই কুলধারা হয়ে উঠেছিল রাজস্থানের অন্যতম এক কেন্দ্র।
কিন্তু হঠাৎ করেই এমন মৃত্যুপুরী হয়ে উঠল কুলধারা? তা নিয়েই প্রচলিত রয়েছে একাধিক লোককথা, জনশ্রুতি। তারই মধ্যে একটি প্রচলিত জনশ্রুতি জানায়, ১৮২৫ সালে রাখী পূর্ণিমার রাতে গ্রামের প্রায় ১৫০০ বাসিন্দা গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আর তার কারণ ছিল অত্যাচারী এক শাসক। শাসক বলা ভুল হবে। সেসময় জয়সালমিরের মসনদে রাজা থাকলেও, সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সেখানকার প্রধানমন্ত্রী সালিম সিংহ।
অত্যাচারী শাসকের লোলুপদৃষ্টিরই শিকার হয়েছিল সমৃদ্ধশালী কুলধারা। সালিম সিংহ ক্রমাগত বাড়িয়ে যেতে লাগলেন রাজস্বের পরিমাণ। আর সেই খাজনা না মেটাতে পারলেই জুটত নৃশংস শাস্তি। গ্রামবাসীদের প্রাণ নিতেও হাত কাঁপত না তাঁর। সামান্য মর্যাদাটুকুও পেত না সমাজের মহিলারা। জোর করেই তাঁদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হত প্রাসাদে। তারপর চলত অকথ্য নির্যাতন। যৌননিগ্রহের পর মেরে ফেলা হত তাঁদের।
আরও পড়ুন
একুশ শতকেও উপনিবেশ! আফ্রিকার শহর ঘিরে দ্বন্দ্ব স্পেন-মরক্কোর
এই ঘটনারই প্রতিবাদ করেছিলেন কুলধারার গ্রামপ্রধান। তাঁর কন্যা তখনও অবিবাহিতা। সালিম সিংহের দৃষ্টি পড়ল সেইদিকেই। সেনাবাহিনী পাঠানো হল গ্রামে। তাঁর সঙ্গে শাসকের বিবাহ দিলে যে বিনা রক্তক্ষয়েই সমাধান হবে এই সমস্যার, জানানো হল তেমনটাই। কিন্তু পরিস্থিতিতে বদলানোর নয়, তা ভালোই জানতেন গ্রামবাসীরা। আর ঘরের মেয়েকে তো এভাবে তুলে দেওয়া যায় না এমন একজন শাসকের হাতে। তবে উপায়? আবার সেনাদের ফিরিয়ে দিলেও যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে পরিস্থিতি।
আরও পড়ুন
বাতিল বই কুড়িয়েই আস্ত লাইব্রেরি, কলম্বিয়ার ‘বইয়ের রাজা’ এক সাফাইকর্মী
শেষ পর্যন্ত ছলের শরণাপন্ন হলেন তাঁরা। সেনাদের থেকে আর একদিন সময় চেয়ে নিলেন গ্রামপ্রধান। সেনাদের বলা হল, সন্ধে হয়ে যাওয়ার পর ঘরের মেয়েকে বিদায় জানানোর রীতি নেই সেখানে। পরদিন সকাল হলেই কন্যাকে তিনি পাঠাবে রাজমহলে। সেই কথাই মেনে নিয়েছিল সালিম সিংহ। তবে পরদিন শহরে গিয়ে একজন বাসিন্দাকেও আর খুঁজে পায়নি সেনারা। গোটা শহর সেদিন যেন শুনশান প্রান্তর। ব্যাপার কী? ঠাহর করতে পারেননি তাঁরাও।
আরও পড়ুন
বাঙালি স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের হাতেই তৈরি ভারতের ‘গোলাপি শহর’ জয়পুর
জনশ্রুতি অনুযায়ী, শাসকের হাত থেকে বাঁচতে গোটা শহরের বাসিন্দারাই সেদিন রাতে পাড়ি দিয়েছিল যোধপুরের পালিতে। তিল তিল করে গড়ে তোলা আস্ত একটা নগরীকেই ছেড়ে রেখে চলে গিয়েছিল মহিলাদের সম্মান রক্ষার জন্য। তবে যাওয়ার আগে তাঁদের অভিশাপ ছিল, এই শহর আর কোনোদিন বাসযোগ্য হবে না সাধারণ মানুষের জন্য।
সত্যিই, শতাব্দী পেরিয়ে এসে এখনও মৃত্যুপুরী জয়সালমিরের কুলধারা। কিন্তু সত্যিই কি তাঁরা সেদিন পালিতে ফিরে গিয়েছিলেন? জানা নেই সঠিক উত্তর। কারণ, পালির ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে এই জনশ্রুতি যাই হোক না কেন, ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে প্রচণ্ড খরার শিকার হয়েছিল এই শহর। সেইসঙ্গে বিপুল অঙ্কের রাজস্বের বোঝা টানা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তাঁদের কাছে। ফলে সাধের এই নগরী পরিত্যাগ করেন প্রায় দেড় হাজার গ্রামবাসী।
কুলধারা সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে অদ্ভুত সব কাহিনি। প্রেতশিকারিদের মতে, এই শহরে এখনও ঘুরে বেড়ায় অতৃপ্ত আত্মারা। স্থানীয়দের অভিমত সালিম সিংহের শিকার হওয়া নিষ্পাপ রমণীরাই এখন পিশাচ হয়ে উঠেছে শহরের। এমনকি ধুলোর ওপরে ছোট্ট শিশুর পায়ের ছাপের কিছু ছবি, ঘুঙুরের শব্দের রেকর্ডকে হাতিয়ার করেও প্রেতশিকারিরা দাবি করেন, এই শহর সত্যিই ভৌতিক। তবে সে যাই হোক, আজ কুলধারা রাজস্থানের অন্যতম এক আকর্ষণ। কুলধারার এই ভৌতিক পরিমণ্ডলকেই কাজে লাগিয়েই অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র করে তুলেছে জয়সালমির সরকার। ইতিহাস এবং ভৌতিকতার সাক্ষী হতে সারাবছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে কুলধারায়। তবে এসব শুধু সকালেই। সন্ধে গড়ালেই আবার জনশূন্য হয়ে পড়ে রাজস্থানের এই মরুশহর…
Powered by Froala Editor