১৯২৫ সাল। আমেরিকার ইন্ডিয়ানা (Indiana) প্রদেশের বিস্তৃত বালিয়াড়ির মধ্যে পাওয়া গেল ‘ডায়না’-র মৃতদেহ। কেউ বলে সন্তান প্রসবকালে মৃত্যু হয়েছে, কারোর মতে দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন, মৃত্যু এল তারই রূপ ধরে। আবার সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়নি তাঁর অত্যাচারী ‘স্বামী’ পল উইলসনকেও। কিন্তু আসল গল্প শুরু হল মৃত্যুর পর। প্রায়ই সমুদ্রতটে দেখা দিতে লাগলেন ডায়না। রাতের জ্যোৎস্নায় তাঁর অশরীরী আত্মা পাহারা দেয় ইন্ডিয়ানার বালিয়াড়ি ও বনভূমি। যার জন্য শিকাগোর সমস্ত সুখসম্পদ ছেড়ে এই নির্জনতায় এসে থাকার সিদ্ধান্ত, সেই বালিয়াড়িকে ছাড়তে পারেননি মৃত্যুর পরেও। গল্প থেকে উপকথার নায়িকায় পরিণত হলেন ‘ডায়না অফ দ্য ডুনস’ (Diana of the Dunes)।
আসল নাম অবশ্য অ্যালিস মাবেল গ্রে (Alice Mabel Gray)। কীভাবে তিনি ‘ডায়না’ হয়ে উঠলেন, সেই গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভূতের রহস্য। ১৮৮১ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে জন্ম। ছোটোবেলা থেকেই পড়াশোনায় তুখোড়। অঙ্ক, জ্যোর্তিবিদ্যা আর বিভিন্ন ভাষায় প্রবলভাবে সাবলীল। শিকাগো ইউনিভার্সিটি থেকে পড়া শেষ করে কিছুদিন চাকরিও করলেন। কিন্তু ভালো লাগছিল না এইসব। অর্থের পিছনে ছোটা, সাফল্যের ইঁদুর দৌড়, শহরের চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যে স্বাধীনতা আর নিজস্বতার বড়ো অভাব। ১৯১৫ সালের একদিন সব ছেড়ে পাড়ি দিলেন নিরুদ্দেশের দেশে। একাই বাসা বাঁধলেন ইন্ডিয়ানার সমুদ্রপাড়ের বালিয়াড়িতে। গাছপালা দিয়ে বানালেন একটা ছোট্ট ঘর। নাম রাখলেন ‘ড্রিফটউড’।
ইন্ডিয়ানা প্রদেশ তো বটেই, সমগ্র আমেরিকা জুড়েই তখন শিল্পের জোয়ার এসেছে। শুরু হয়েছিল বিশ শতকের গোড়ার দিকেই। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে যেন এক ধাক্কায় গতি বাড়িয়ে দেয়। আমেরিকার একাধিক ভারী শিল্পসংস্থা এই সুযোগে হাত দেয় ইন্ডিয়ানার সমুদ্রতটে কারখানা বানানোর কাজে। কোপ পড়তে থাকে তীরবর্তী অরণ্যভূমিতে, উৎখাত করা হয় অনেক মানুষকে। বালিয়াড়ির অস্তিত্বও পড়ে সংকটের মুখে। প্রতিবাদে বহু মানুষ শামিল হলেও মূলত শহরেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছিল সমস্ত স্লোগান। অ্যালিস হয়ে উঠলেন তাদের সংযোগের মাধ্যম, প্রতিরোধের প্রধানতম মুখ। ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করে সংস্থাগুলি।
এই ঘটনার পর মিডিয়ার সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়েন অ্যালিস। যেখানে স্থানীয় উপজাতিরদেরই পর্যাপ্ত খাদ্য মেলে না, সেখানে একা একটি মেয়ে কীভাবে রয়েছে এখানে? স্থানীয় লোকেদের মুখে শোনা যায় তাঁকে নিয়ে রহস্যময় সব গল্প। তাঁর জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, পোষাক—কোনোটাই বাদ রইল না আকাশকুসুম কল্পনা থেকে। আর সেগুলিই মুখরোচক খাদ্যের মতো ছড়িয়ে পড়ে শহরে। এক সুন্দরী যুবতী স্বেচ্ছায় সঙ্গীহীন জীবন কাটাচ্ছে সমুদ্রতটে। রোমান পুরানকাহিনি অনুসারে তাঁর নাম রাখা হয় ‘ডায়না অফ দ্য ডুনস’। লোকের কৌতূহল বাড়ে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে মিডিয়ার ভিড়। সেলিব্রিটি হয়ে যান তিনি। যার জন্য সব কিছু ছেড়ে আসা, সেই নাগরিক সভ্যতা ফের হানা দেয় জীবনে। কিন্তু অ্যালিস তো চেয়েছিলেন শুধু নিজের মনে পড়াশোনা করতে। ইন্ডিয়ানার মানুষদের নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি পরিবেশতত্ত্ব নিয়ে তৈরি করছিলেন দীর্ঘ একটি গবেষণাপত্র।
আরও পড়ুন
ব্রাউন লেডি, এক ‘সত্যি’ ভূতের ছবি
খোঁজ পাওয়া যায়নি সেসবের। কারণ, পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর কুঁড়েঘরটি। ১৯২১-এই অবশ্য একাকিত্বের জীবন ছেড়ে সঙ্গী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন পল উইলসনকে। পেশায় মৎস্যজীবী, মেজাজ সবসময় উগ্র। জড়িয়ে পড়েন খুনের মামলায়। সেই সুযোগে পুলিশ হানা দেয় ডায়নার বাসায়। বিবাদ বাড়তে থাকায় গুলি চালায় পুলিশ। গুরুতর আহত হন ডায়না। আর তখনই আগুন লাগিয়ে দেওয়া কুঁড়েঘরে। পুলিশের এত সক্রিয়তা পরিকল্পনামাফিক কিনা, সেই নিয়ে উঠে গেছিল প্রশ্ন।
আরও পড়ুন
ভূতের মুখে ‘গুডবাই’! ব্রিটেনের ঘটনায় চাঞ্চল্য সোশ্যাল মিডিয়ায়
১৯২৫-এ মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মারা যান ডায়না। মৃত্যুর কারণ বিষয়ে সহমত মেলে না, কারণ তিনি শহুরে হাসপাতালে ভর্তি হতে অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুও রয়ে গেছে রহস্যের আড়ালে, যেরকম রহস্যময় তার পরের ঘটনা। তিনি নাকি ঘুরে ঘুরে বালিয়াড়িকে রক্ষা করেন। অনেকেই তাঁকে দেখেছে গভীর রাতে সমুদ্রে স্নান করতে। ফের হইচই শুরু করে মিডিয়াও। অতিকথন অবশ্যই ছিল, কিন্তু জীবৎকালেই ডায়নাকে নিয়ে ছড়িয়েছিল বহু গল্প। ফলে লোকে অস্বীকার করেনি তাঁর ‘আত্মা’-কে নিয়ে তৈরি হওয়া গল্পগুলি।
বাস্তবের পর্দা সরিয়ে ক্রমে কিংবদন্তিতে পরিণত হন ডায়না। গল্পগুলি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে যায় যে, শিল্পসংস্থাগুলি দীর্ঘদিন পর্যন্ত উৎসাহ দেখায়নি। পরবর্তীতে তারা আবার কারখানা বসাতে চাইলে নতুন করে শুরু হয় প্রতিবাদ। এবারও প্রধান মুখ ডায়না। বা বলা ভালো তাঁকে নিয়ে তৈরি গল্পগুলি। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা সরকার সংরক্ষণ করে এই অঞ্চলের বনভূমি। যার বর্তমান নাম ‘ইন্ডিয়ানা ডুনস ন্যাশনাল পার্ক’। আর ডায়না যেন এই অরণ্যের ‘চলমান অশরীরী’। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদে আজও লেখা হয়ে আছে তাঁর সমস্ত অলৌকিক কাহিনি।
Powered by Froala Editor