পুরুষের যৌনলিপ্সার শিকার হত নারীবেশী কিশোররা; ঘাঁটু গান ও বাংলার এক ‘অশ্লীল’ সংস্কৃতি

নদনদীর দেশ বাংলা। নদীকে ঘিরেই এখানে গড়ে উঠেছে মানুষের আলো-আঁধারি জীবন। তখনও মানুষ নিজেদের ঘরের মধ্যে বিনোদনের হাজার উপকরণ নিয়ে হাজির হয়নি। তাই সবটাই ছিল সামাজিক। তাতে সম্প্রীতির আহ্বান যেমন ছিল, তেমনি ছিল নানান সামাজিক ব্যাধি। এদেশে তখন সদ্য ফিরিঙ্গি জাহাজ এসে ভিড়তে শুরু করেছে। তখনও বর্ষায় কূল ছাপিয়ে যখন নদীর জল হাওরে জমা হত, তখন সেই এলাকার মানুষের কাজ বলতে কিছুই থাকত না। দিন কাটত আমোদে-আনন্দে। আর সেই আনন্দকে উস্কে দিতে ঘাটে ঘাটে নৌকো ঘুরে বেড়াত। নৌকোয় থাকত একদল নারীবেশী সদ্য-কিশোর। ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়াত বলে তাদের নাম হয়েছিল ঘাঁটু ছোকরা। আর এই ঘাঁটু ছোকরাদের নাচই ছিল ঘাঁটু নাচ।

বাংলা সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া অনেক উপকরণের কথা বলতে গেলে ঘাঁটু গানের কথা এসেই পড়ে। কিন্তু তার ইতিহাসে ঐতিহ্যের উজ্জ্বল দিকটার তুলনায় যেন অন্ধকার দিকটাই বেশি। এই ইতিহাস মনে পড়িয়ে দেয় অসংখ্য কিশোরের উপর যৌন নির্যাতনের ছবি। তখনও চাইল্ড অ্যাবিউজ নিয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি পৃথিবীর কোথাও। তাই সেই ছেলেদের কান্নার খবর যে কেউ রাখেনি, সেকথা বলাই বাহুল্য। ঘাঁটু গানের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্ক আছে। তবে মোটামুটি মনে করা হয় ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে শ্রীহট্টের কাছে আজমিরিগঞ্জ এলাকার এক বৈষ্ণব আচার্য ও তাঁর কম বয়সী শিষ্যদের রাধাভাবকে আশ্রয় করে ঘাঁটু গানের সূত্রপাত। আর তাই শেষ সময় পর্যন্ত ঘাঁটু ছোকরাদের নাচের সঙ্গে যে চটুল গান ব্যবহৃত হত, তার বিষয়বস্তুও হতো রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, বিশেষ করে রাধাবিরহ।

তবে ক্রমশ এই ধর্মীয়-দার্শনিক সীমারেখা অতিক্রম করে ঘাঁটু গান হয়ে ওঠে এক ধরনের যৌনলিপ্সার প্রতীক। আর সেই লিপ্সার শিকার ঘাঁটু-ছোকরারাই। তাদের লম্বা চুল রাখা এবং মহিলাদের মতো সাজপোশাক করা বাধ্যতামূলক ছিল। এমনকি মহিলাদের মতো চালচলনও অভ্যেস করতে হত তাদের। আর এই নারীবেশী কিশোরদের মাঝখানে রেখে চটুল গানের তালে তালে রীতিমতো বাইজির মতো নাচতে হত। এতেই তৃপ্ত হত মানুষের আকাক্ষা।

একটি ঘাঁটু দলে একজন মূল ঘাঁটু ছোকরা ছাড়াও বেশ কয়েকজন সদস্য থাকত। তারা প্রত্যেকেই ছিল ঘাঁটু, অর্থাৎ তাদেরও মেয়ে সেজে থাকতে হত। আর থাকতেন একজন ‘সরকার’ বা ‘মরাদার’ (মহড়াদার>মরাদার)। এই সরকাররাই ঘাঁটুকে নাচে-গানে এবং তত্ত্বকথায় পারদর্শী করে তুলতেন। এছাড়া আরও যাঁরা থাকতেন তাঁরা হলেন দোহার বা পাইলদার। এঁরা ছিলেন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী, সময় সময় গানের দোহার ধরতেন। ঘাঁটুর সঙ্গে সমস্বরে উচ্চগ্রামে সুর তুলে তাঁরা দর্শকের মন মাতিয়ে তুলতেন। তখন ঢোল, খোল, করতাল বাঁশির পাশাপাশি হারমোনিয়াম এবং দোতারাও ব্যবহার করা হত।

আরও পড়ুন
একসময় গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরত, আজ হারিয়ে যেতে বসেছে সাঁওতালি ‘চাদর-বাঁধনী’ পুতুল নাচ

একটি দলের একক অনুষ্ঠানের প্রচলন যেমন ছিল, তেমনই ছিল দুটি ঘাঁটু দলের প্রতিযোগিতার প্রচলনও। তখন একটি দল গানের কথায় অপর দলকে একটি প্রশ্ন করত, আর সেই দলকে উত্তর দিতে হত গানের মাধ্যমেই। খানিকটা কবিয়ালের মতো। তবে কবিয়ালের ক্ষেত্রে দার্শনিক উপসঙ্গ প্রধান হয়ে উঠলেও এখানে সেই অবকাশ ছিল না। এখানে চটুলতাই ছিল প্রধান। স্থানে স্থানে বিপক্ষ দলকে পরাজিত করতে অশ্লীল রসিকতার আশ্রয় নিত ঘাঁটুরাও। তবে তার থেকেও অন্ধকার ভবিষ্যত অপেক্ষা করে ছিল এই গানের ধারাটির জন্য। আর সেটা এলো সতেরো-আঠেরো শতক নাগাদ।

সতেরো-আঠেরো শতক নাগাদ ঘাঁটু ছোকরাদের কিনে নেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। যাঁরা ছেলেদের কিনে নিতেন তাঁদের বলা হতো ‘সৌখিনদার’ বা ‘খলিফা’। এঁরা কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। ঘাঁটু ছোকরাদের তাঁরা ব্যবহার করতেন উপপত্নীর মতো। এমনকি অনেক লোককথায় এমনও জানা যায় যে সৌখিনদারদের স্ত্রীরা ঘাঁটু ছোকরাদের ঈর্ষা করতেন। তবে ঘাঁটু ছোকরাদের দিনের পর দিন এভাবে নির্যাতিত হওয়ার যন্ত্রণার খোঁজ কেউ রাখতেন কি? হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রতেও ফুটে উঠেছে কিশোরদের এই যন্ত্রণাকাতর জীবনের ছবি।

আরও পড়ুন
নতুন বিতর্কের জন্ম রবীন্দ্রভারতী প্রাঙ্গণে, আদৌ কি বিপন্ন বাঙালির সংস্কৃতি?

ক্রমশ বিশ শতকে এসে যখন নাচগানের থেকে এই অশ্লীল যৌনাচারের দিকটাই প্রধান হয়ে ওঠে, তখন আর এই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার কোনো জায়গা ছিল না। ‘ঘাঁটু’ শব্দটি ক্রমশ অপভাষায় পরিণত হয়। আর সেইসঙ্গে ছোটদের নিরাপত্তার বিষয়টিও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলির রাধাভাবের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মুক্তির কথা লুকিয়ে ছিল বলে মনে করেন অনেকেই। অথচ সেই একই মূল থেকে জন্ম নিয়েছিল এমন একটি ঘৃণ্য প্রভাব। আমাদের সংস্কৃতিতে যেমন গর্ব করার মতো উপাদানেরও অভাব নেই, তেমনই ‘ঘাঁটু’ গান এক অব্ধকার ইতিহাসের কথাই মনে পড়ায়। যে ইতিহাসকে ফেলে আসতে পারা সত্যিই এক সামাজিক সাফল্য।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
যুবতীর বেশে আসর মাতায় পুরুষরাই, বিলুপ্তির পথে গ্রামবাংলার ‘ছোকরা নাচ’

More From Author See More