সাল ১৯৪২। সেদিনও ছিল এরকমই এক ২৯ সেপ্টেম্বর। ততদিনে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে শুরু হয়ে গেছে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’। গোটা দেশের সঙ্গে মেদিনীপুরের মাটিও জ্বলে উঠেছে। রাস্তায় নেমে আসছেন মানুষেরা; লক্ষ্য কেবল স্বাধীনতার। ঠিক হল, তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা ও নন্দীগ্রাম থানা দখল করা হবে। যাতে অত্যাচারী ব্রিটিশদের সরিয়ে এখানে স্বাধীন, স্বতন্ত্র সরকার গঠন করা যায়। পরিকল্পনামাফিক শুরু হল ঘেরাও কর্মসূচি। পাঁচদিক থেকে পাঁচটি বিরাট মিছিল এগিয়ে আসছে তমলুক থানার দিকে। পুলিশরা বন্দুক, লাঠি নিয়ে তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু সেসব তো পরোয়া করেন না মেদিনীপুরের মানুষ। ব্রিটিশরা অবাক হয়ে দেখল, একটি মিছিলের পুরোভাগে রয়েছেন এক বৃদ্ধা। এক হাতে জাতীয় পতাকা, অন্যহাতে শঙ্খ। সেইসঙ্গে গলায় একটাই মন্ত্র— ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! ইংরেজ ভারত ছাড়ো!’ ব্রিটিশদের অধীনে থাকা পুলিশ বাহিনি জানেন মেদিনীপুরের এই ৭৩ বছর বয়সী বৃদ্ধার পরিচয়। লোকে ‘গান্ধীবুড়ি’ বলে বটে; আসল নাম মাতঙ্গিনী হাজরা…
তমলুকের এক অতি সাধারণ কৃষক ঠাকুরদাস মাইতির ঘরে যখন ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান জন্মাল, তখন তিনি কি ভেবেছিলেন তাঁর মেয়েই একদিন বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতের বিপ্লবের মানচিত্রে চিরস্থায়ী জায়গা পাবে? সাধারণ পরিবার, দিন আনেন দিন খান। এসব স্বপ্ন দেখা কি তাঁদের সাজে? ইতিহাস কি আর এমন মানুষদের জায়গা দেবে? আর মেয়ে হয়ে জন্মেছে যখন, তখন তো বিয়ের চিন্তাও করতে হবে! মাতঙ্গিনী হাজরার প্রাথমিক পড়াশোনা সেরকম এগোয়নি; অল্প বয়সেই ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। সেই দাম্পত্য যাত্রাও দীর্ঘদিন হয়নি। মাত্র আঠেরো বছর বয়স ছিল মাতঙ্গিনী’র, কপালের সিঁদুর মুছে গেল চিরতরের জন্য…
এদিকে সন্তান-সন্ততিও নেই। কিন্তু সেসব দিকে মন ছিল না মাতঙ্গিনী হাজরার। ততদিনে দেখেছেন মেদিনীপুরের মাটিতে বিপ্লবকে জন্মাতে। দেশে জাঁকিয়ে বসেছে স্বাধীনতার চেতনা। সেই স্রোত থেকে নিজেকে ফেরাতে পারলেন না তিনি। ১৯০৫ সাল। লর্ড কার্জনের শ্যেনদৃষ্টি বাংলাকে ভাগ করে দিল। আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল! আর সেই তাপে জন্ম হল একের পর এক বিপ্লবীর। কেউ নরমপন্থী; কেউ আবার বিপ্লবের রাস্তায়, লড়াইয়ের রাস্তায় নিজেকে অর্পণ করল। সেই সারণি ধরেই উঠে এলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। মেদিনীপুরের মাটিতে জড়ো করতে লাগলেন বাকি মেয়েদের। একটাই মন্ত্র, একটাই লক্ষ্য— স্বাধীনতার। মাতঙ্গিনী’র লড়াইও শুরু সেই বঙ্গভঙ্গ থেকে। এ যে এক অনন্ত যাত্রা!
নিজের সামনে আদর্শ হিসেবে দেখেছিলেন মহাত্মা গান্ধীকে। যখনই সুযোগ হত, নিজেই চরকা কেটে সুতো বানাতেন। গান্ধীজির প্রতিটা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। তাঁর বিপ্লবের ক্ষেত্র ছিল মেদিনীপুর, তমলুক। সেখানে থেকেই একের পর এক পদক্ষেপ নিতেন। মনে পড়ে ১৯৩০ সালের কথা। গান্ধীজি ডাক দিয়েছেন ডান্ডি অভিযানের। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছে আরেকটি অভিযান— লবণ সত্যাগ্রহ। ব্রিটিশরা চাইছিল, লবণ তৈরির রাশ তাঁদের হাতেই থাকুক। কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য করে যে যেখানে পেরেছেন, লবণ তৈরি করে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এদিকে মেদিনীপুর তখন বিপ্লবীদের আখড়া। এই মাটি দেখেছে ক্ষুদিরামকে। কাজেই সেই রক্ত সংক্রমিত হয়েছে বাকিদের মধ্যেও। কাঁথিতে নোনাজল থেকে লবণ তৈরি করার পর পুলিশরা রাস্তায় নামল। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল মেদিনীপুরে। আর সেই ঢেউয়ের অন্যতম হাল ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা।
আরও পড়ুন
‘জেল না-খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী’ গোষ্ঠ পাল; ব্রিটিশদের অন্যায়ের প্রতিবাদে ছেড়েছিলেন ফুটবলও
লবণ সত্যাগ্রহের সময়ই প্রথমবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলন থামেনি। বরং যত দিন গেছে, মাতঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন মেদিনীপুরের বীর নারীদের মুখ। পরবর্তীকালে কর মকুবের দাবিতে আবারও জ্বলে ওঠে মেদিনীপুর। তখন কয়েক মাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন তিনি। সেসব অবশ্য পরোয়া করেননি মাতঙ্গিনী। দেশের স্বাধীনতার জন্য জেলবন্দি হওয়াও যে এক বিরাট সম্মানের! এইভাবেই হয়ে উঠেছিলেন ‘গান্ধীবুড়ি’। তবে আকাশে আসল নিশান উড়ল ’৪২-এ। ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’-র মন্ত্রে গোটা ভারতকে এক করে দিয়েছেন গান্ধীজি। তিনি এবং কংগ্রেসের অন্যান্য বড়ো নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এক কথায়, মাথার ওপর নেতৃত্ব নেই। এই আবহাওয়ায় আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে উঠল। হঠাৎই দেশের মানচিত্রে জায়গা করে নিল মেদিনীপুরের একটি অঞ্চল— তমলুক। সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীলকুমার ধাড়া প্রমুখ বিপ্লবীরা ঠিক করলেন, ব্রিটিশ শাসন থেকে এই জায়গাকে মুক্ত করবেন। সেই অনুযায়ী ঠিক হল আন্দোলনের কর্মসূচি। আর এই পুরো ঘটনায় তাঁদের অন্যতম ভরসার জায়গা ছিল ৭৩ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। অশক্ত শরীর; কিন্তু মনের তেজ এখনও প্রবল। ইংরেজদের সমূলে উৎখাত করতে হবে।
এরপর, ’৪২-এর ২৯ সেপ্টেম্বর। নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী তমলুক থানা ঘেরাও করা হবে। মিছিলের একদম সামনে ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। শক্ত করে জাতীয় পতাকা ধরে রেখেছেন। দৃপ্ত তাঁর চলন, শরীরে নতুন তেজ। এই আগুনে ব্রিটিশদের জ্বলতে হবেই। উল্টোদিকে ব্রিটিশ পুলিশও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বন্দুক, লাঠি, বেয়নেট নিয়ে এগিয়ে এসেছে তাঁরাও। হঠাৎই চলল গুলি। বেশ কয়েকজন লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। মিছিলটা একটু যেন কেঁপে উঠল, পেছনে সরে গেল। গর্জে উঠলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। ভয় কীসের! পিছিয়ে যাব কেন! থানা তো সামনে; অতএব লক্ষ্য পূরণ না হওয়া অবধি আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শাঁখ বাজিয়ে নিজেই এগিয়ে নিয়ে গেলেন মিছিলটা…
এবারে ছুটে এল আরও কিছু বুলেট। একটি বুলেট লাগল পায়ে, আরেকটি হাতে। শঙ্খ মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। একটু নুয়ে পড়লেন; তারপর আবার এগিয়ে চললেন গান্ধীবুড়ি। এরপর আরেকটি বুলেট! সোজা এসে দু-ভুরুর মাঝখানে বিদ্ধ হল। মাতঙ্গিনী এবার আর কিচ্ছু করতে পারলেন না। রক্তে ভেজা নিষ্প্রাণ দেহটা পড়ে গেল মাটিতে। বিপ্লবীরা দেখলেন, তখনও শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছেন ভারতের জাতীয় পতাকা। ত্রিবর্ণ রংটা একটু লাল হয়ে গেল…
কলকাতার ময়দান অঞ্চলে হাঁটলে একটি মূর্তি আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। পতাকা হাতে এক বৃদ্ধার মূর্তি। কার, সেটা নতুন করে বলে দিতে হয় না। উল্লেখ্য, স্বাধীন ভারতে কলকাতার প্রথম নারীমূর্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। ঠিক যেখানে তিনি শহিদ হয়েছিলেন, সেখানেও এমনই একটি মূর্তি রয়েছে। হয়ত সেখানে দাঁড়ালে সামনে হাজির হবেন গান্ধীবুড়ি। কপালের মাঝখানে একটা গর্ত; আগুন হয়ে জ্বলছে! শিল্পীর দক্ষতায় নয়, বিপ্লবের আগুন তাঁকে দেবীত্ব দিল, সৃষ্টি করল ত্রিনয়ন…
আরও পড়ুন
পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় স্বাধীনতা দিবস ১৫ নয়, ১৮ আগস্ট!
তথ্যসূত্র—
১) ‘নারীশক্তির অদম্য প্রতিমা গান্ধীবুড়ি মাতঙ্গিনী’, জয়সূর্য ঘোষ, স্কুপিপোস্ট
২) ‘এক দুরন্ত সাহসের নাম মাতঙ্গিনী হাজরা’, সঞ্জীব, ঢাকা জার্নাল
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
১৬৮ বছর আগে, এই হুল দিবসেই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতার প্রথম আহ্বান