সূর্যস্নান।। পর্ব ৬।।
সমস্ত শোকের মধ্যে সবচেয়ে অসহনীয়, সবচেয়ে তীব্র বোধ করি সন্তানশোক। যাঁর আগে যাবার কথা, তিনি পড়ে রইলেন, আর তাঁর চোখের সামনে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল তাঁরই আত্মজ - এ কি সহ্য করা যায়? এ-শোক রবীন্দ্রনাথের জীবনে এসেছে তিনবার। আর আশ্চর্যভাবে, অমানুষিক মনোবল আর স্থৈর্যের সাহায্যে, তিনি বারবার এই বেদনাকে জয় করতে সমর্থ হয়েছেন। ঈশ্বরের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস তাঁকে নিরন্তর ভরসা জুগিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে এ-কথা বর্ণে বর্ণে সত্য, "যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি।"
১৯০৩ সালের কথা। কবিপত্নীর মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই, কবির মধ্যমা কন্যা রেণুকা গুরুতর অসুখে পড়ল। হাজারিবাগ ও আলমোড়ায় হাওয়া বদল করেও বিশেষ উপকার হল না, অসুখ বেড়েই চলল। আলমোড়ায় কন্যার শয্যার পাশে বসে, তার মনকে একটু প্রফুল্ল করার চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ খানকতক কবিতা রচনা করে শুনিয়েছিলেন, পরে সেগুলি 'শিশু' বইতে স্থান পেয়েছে। কদিন বাদে, মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন কবি। কিছুদিনের মধ্যেই গতাসু হলেন রেণুকা।
রেণুকার মৃত্যুতে কবির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল, আমরা জানি না। বহু বছর পরে, নির্মলকুমারী মহলানবীশের কাছে কবি সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন,
"মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমাকে বললে- বাবা, পিতা নো'সি বলো। আমি মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার শেষ নিঃশ্বাস পড়ল। তার জীবনের চরম মুহূর্তে কেন সে 'পিতা নো'সি' স্মরণ করল, তার ঠিক মানেটা আমি বুঝতে পারলুম। তার বাবাই যে তার জীবনের সব ছিল, তাই মৃত্যুর হাতে যখন আত্মসমর্পণ করতে হল, তখনো সেই বাবার হাত ধরেই সে দরজাটুকু পার হয়ে যেতে চেয়েছিল। তখনো তার বাবাই একমাত্র ভরসা এবং আশ্রয়। বাবা কাছে আছে জানলে আর কোনো ভয় নেই। সেইজন্য ভগবানকেও পিতারূপেই কল্পনা করে তাঁর হাত ধরে অজানা পথের ভয় কাটাবার চেষ্টা করেছিল। এই সম্বন্ধের চেয়ে আর কোনো সম্বন্ধ তার কাছে বেশি সত্য হয়ে ওঠেনি। ...তার সেই শেষ কথা যখন-তখন আমি শুনতে পাই - বাবা, পিতা নো'সি বলো।"
সব কয়টি শব্দের মধ্যে যেন গাঢ় অশ্রু জমাট বেঁধে আছে, তাই না! কিন্তু এখানেই শেষ নয়, আবার আসবে সন্তানশোক। আরো দু-দু'বার।
আরও পড়ুন
‘বিবিধ গানে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যদি নিজেকে আরও একটু বেশি করে দিতেন!
১৯০৭ সালে চলে গেল কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ। পুজোর ছুটিতে বন্ধুপুত্র সরোজচন্দ্রের সঙ্গে মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়েছিল শমী। সেখানেই তার কলেরা হল। টেলিগ্রাফ পেয়ে কবি কলকাতা থেকে মুঙ্গেরে রওনা দিলেন, বোলপুর থেকে ভূপেন্দ্রনাথ কবির সঙ্গ নিলেন। মুঙ্গেরে শমীর মৃত্যু হল ৭ অগ্রহায়ণ। পাঁচ বছর আগে, ঠিক এই দিনটিতে কলকাতায় অকালে প্রয়াত হয়েছিল কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী।
মৃত্যুর সময় শমীর বয়স ছিল তেরো বছর মাত্র। সে বাবার বড়ো আদরের ছেলে, আকৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ। এই শোক কবিকে নিদারুণভাবে আঘাত করেছিল, কিন্তু শোকের অসংযত প্রকাশ কোথাও নেই। কবির সেই নিরুদ্ধ শোক আধ্যাত্মিক সান্ত্বনারূপে নবকলেবর ধরে প্রকাশ পেয়েছিল সাহিত্যের অঙ্গনে।
শিলাইদহে এসে রচনা করলেন একের পর এক গান- ‘অন্তর মম বিকশিত কর’, ‘প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে’। সম্ভবত ‘তুমি নব নব রূপে’ গানটিও এই সময়েই লেখা। শিলাইদহ বাসকালেই কবি রচনা করলেন মাঘোৎসবের ভাষণ, তার শিরোনাম 'দুঃখ’। এই ভাষণের অন্তর্গত প্রার্থনায় কবি তাঁর সদ্যোপ্রাপ্ত দুঃখের সান্ত্বনা চেয়ে বলেছেন, "হে রাজা, তুমি আমাদের দুঃখের রাজা; হঠাৎ যখন অর্ধরাত্রে তোমার রথচক্রের বজ্রগর্জনে মেদিনী বলির পশুর হৃৎপিণ্ডের মতো কাঁপিয়া উঠে তখন জীবনে তোমার সেই প্রচণ্ড আবির্ভাবের মহাক্ষণে যেন তোমার জয়ধ্বনি করিতে পারি; হে দুঃখের ধন, তোমাকে চাহি না এমন কথা সেদিন যেন ভয়ে না বলি; সেদিন যেন দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া তোমাকে ঘরে প্রবেশ করিতে না হয়- যেন সম্পূর্ণ জাগ্রত হইয়া সিংহদ্বার খুলিয়া দিয়া তোমার উদ্দীপ্ত ললাটের দিকে দুই চক্ষু তুলিয়া বলিতে পারি, হে দারুণ, তুমিই আমার প্রিয়।"
আরও পড়ুন
কণিকা-কে রঙের চৌবাচ্চায় ফেলে দিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, ‘শাস্তি’র ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথের
অনুসন্ধানী পাঠক নিশ্চয়ই কবির আরও বহুতর গান, কবিতা এমনকি নাট্যের মধ্যেও এই অপূর্ব চিত্রকল্পমালার প্রতিধ্বনি শুনতে পাবেন!
বহু বছর পর, দৌহিত্র নীতীন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ কন্যা মীরাকে সান্ত্বনা দিয়ে একখানি পত্র লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন,
"যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে। ...সেখানে আমাদের সেবা পৌঁছয় না, কিন্তু ভালোবাসা হয়তো বা পৌঁছয়- নইলে ভালোবাসা এখনো টিঁকে থাকে কেন? শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে।"
আরও পড়ুন
তর্কের জবাব দিতেন না ‘বৌঠাকরুন’, কাদম্বরীর কাছে রবীন্দ্রনাথের হার ছিল অবশ্যম্ভাবী
আমাদের নিশ্চিতভাবে মনে পড়ে যাবে কবির অমর কয়েকটি পংক্তি-
"হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে--
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই॥"
কয়েক বছরের মধ্যেই কবির জীবনে হানা দিল তৃতীয় সন্তানশোক। ১৯১৮ সালে কবির জ্যেষ্ঠা কন্যা বেলা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষু হলেন। তখন শান্তিনিকেতন থেকে বিষণ্ণ কবি রথীন্দ্রনাথকে পত্র লিখছেন, "জানি, বেলার যাবার সময় হয়েচে। আমি গিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে পারি এমন শক্তি আমার নেই। এখানে আমি জীবনমৃত্যুর উপরে মনকে রাখতে পারি, কিন্তু কলকাতায় সে আশ্রয় নেই। আমি এইখানে থেকে বেলার জন্যে যাত্রাকালের কল্যাণ কামনা করচি। জানি আমার আর কিছু করবার নেই।"
তাও, কিছুদিন বাদে মেয়েকে দেখতে কলকাতায় এলেন কবি। সন্তানকে শেষবার দেখার টান কি এড়ানো যায়? দুপুরের দিকে জামাতা শরৎচন্দ্রের বাড়িতে মেয়েকে দেখতে যাওয়া শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ (১৬ মে), মেয়ের বাড়ির কাছে যেতেই কান্নার আওয়াজ পেয়ে কবি বুঝলেন, যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন তিনি।
সেদিন বিকেলে 'বিচিত্রা' ভবনে কবির সঙ্গে সাক্ষাতের কথা চিরজীবন মনে রেখেছিলেন জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। অন্য আর পাঁচটা দিনের মতোই সকলের সঙ্গে কবিকে সেদিন স্বাভাবিকভাবে গল্পগুজব করতে দেখা গিয়েছিল। অত বড়ো শোকের চিহ্নমাত্র বাইরে প্রকাশ পায়নি।
কন্যার মৃত্যুর পর, কবির একখানা কবিতার বই বেরিয়েছিল (আশ্বিন, ১৩২৫ বঙ্গাব্দ)। তার নাম 'পলাতকা', তাতে হঠাৎ চলে যাওয়া একগুচ্ছ মানুষের জন্য স্মৃতিকাতর বেদনার অশ্রু জমাট বেঁধে আছে। সেই বইয়ের একেবারে অন্তিম কবিতার নাম 'শেষ প্রতিষ্ঠা'। তাতে ধরা পড়েছে শোক, সান্ত্বনা ও শান্তি বিষয়ে কবির চরমবাক্য-
এই কথা সদা শুনি, ‘গেছে চলে’, ‘গেছে চলে।’
তবু রাখি ব'লে
ব'লো না, ‘সে নাই।’
সে-কথাটা মিথ্যা, তাই
কিছুতেই সহে না যে,
মর্মে গিয়ে বাজে।
মানুষের কাছে
যাওয়া-আসা ভাগ হয়ে আছে।
তাই তার ভাষা
বহে শুধু আধখানা আশা।
আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ
যে-সমুদ্রে ‘আছে' ‘নাই' পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান।
Powered by Froala Editor