১৮ মার্চ, ১৯৪৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি তখন পুরোপুরি মিত্র শক্তির পক্ষে। অন্যদিকে নাৎসি বাহিনীও সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই ঘটল একটি আশ্চর্য ঘটনা। যা রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল নাৎসিদের বুকে। কী ঘটেছিল সেই দিনটিতে?
নাৎসি বাহিনী দেখল, প্রায় ৬০০টি ট্যাঙ্কার নিয়ে রাইন নদী পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে আমেরিকার ৩০ ও ৭৯ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন। কিন্তু ওই এলাকায় প্রতিরক্ষা তেমন মজবুত ছিল না। ফলে অন্যান্য জায়গা থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া হল। মার্কিন বাহিনীকে কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না জার্মানির ভূখণ্ডে। কিন্তু হায় ভগবান! সন্ত্রস্ত মানুষ দেখে এক, আর বাস্তবে তা হয় আরেক। নাৎসি বাহিনী সমস্ত শক্তি নিয়ে মার্কিন বাহিনীকে মোকাবিলা করতে গিয়ে দেখল, কোথায় ট্যাঙ্কার? কোথায় সেনা? সবই আসলে সাজানো প্রপস। ওদিকে যে সমস্ত জায়গা থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে ফাঁকা পেয়ে বিনা প্রতিরোধে ঢুকে পড়েছে আসল মার্কিন সেনা। গুলি-বোমা-কার্তুজ খরচ করতে হল না। কিন্তু যুদ্ধ জিতে নিল আমেরিকাই।
ইতিহাসে এই ঘটনা অপারেশন ভিয়ারসেন নামে বিখ্যাত। অথবা কুখ্যাত। যুদ্ধে নাকি এমন দুর্নীতি মেনে নেওয়া যায় না। মানে এইসব অধর্ম আরকি। তবে ঠিক কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণের মতোই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমন কাজ বারবার করেছে মিত্রশক্তি। আর কে না জানে, ‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’। আর ফেয়ার মানে তো শুধু সুন্দর নয়, সেইসঙ্গে এক কল্পজগতও বটে। যুদ্ধকে সেই প্রকৃত জাদু-বাস্তবতার স্তরে নিয়ে যাওয়ার কাজটা বোধহয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই হয়েছিল জোর কদমে। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডের জাদুকর জ্যাস্পার মাস্কলাইন তাঁর কেরামতি দেখিয়ে দিয়েছেন। সেই জাদুর সামনে দাঁড়িয়ে নাজেহাল হয়েছে প্রবল পরাক্রমী নাৎসি বাহিনী। সেই ঘটনা থেকেই অনুপ্রেরণা পায় মার্কিন বাহিনীও। তাঁরা এই কাজের জন্য রীতিমতো একটা বিভাগ গড়ে তোলেন। আর সেই বিভাগে ছিলেন চিত্রকর, ফ্যাশান ডিজাইনার, ফটোগ্রাফার এমনকি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। সঙ্গে সেনাবাহিনীর কিছু লোকজনও ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ মূল কাজ ছিল না। ইউনিটের কাজ ছিল অবাস্তব ভয় সৃষ্টি করা। নামও ছিল ‘ঘোস্ট আর্মি’।
কর্নেল বিলি হ্যারিস এবং মেজর র্যা লফ ইঙ্গারসোলের চেষ্টাতেই গড়ে ওঠে এই ‘ঘোস্ট আর্মি’। যদিও এই বাহিনী যখন গড়ে ওঠে তখন যুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু তাও যত কম গুলি-বারুদ খরচ করে যুদ্ধ জেতা যায় ততই ভালো। ১৯৯০-এর দশক অবধি অবশ্য বাহিনীর কাজের সমস্ত রেকর্ড ছিল গোপনীয়। কারণ তখনও পর্যন্ত খাতায় কলমে এই বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল। সেই অস্তিত্ব মুছে যাওয়ার পরই যাবতীয় তথ্য প্রকাশ করা হয় ন্যাশানাল ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু মিউজিয়ামে। জানা যায় সামগ্রিক গঠন কৌশলও। প্রায় সব ধরনের ভারী অস্ত্রের ডামি তৈরি করে ফেলেছিলেন তাঁরা। বিশেষ করে তাঁদের তৈরি ট্যাঙ্কারের সঙ্গে আসলের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর দূর থেকে দেখলে তো কথাই নেই। সেইসঙ্গে ছিল ডামি আর্মি। তাঁরা যুদ্ধ করতে পারতেন না। কিন্তু সেনা সেজে ভয় দেখাতে তো পারতেন। তবে সব থেকে মজার কাজটা করেছিলেন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা। তাঁরা দুভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। প্রথমত, কুচকাওয়াজের সময় যে শব্দ হত তার রেকর্ডিং তৈরি করে নাৎসি ছাউনির কিছু দূরে স্পিকার লাগিয়ে চালু করে দিতেন। ফল তাঁরা মনে করতেন মার্কিন বাহিনী আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছেন। কিন্তু আসলে মার্কিন বাহিনী হামলা করত সম্পূর্ণ উল্টো দিক থেকে এবং গোপনে। আর অন্যটা ছিল গোপন টেলিবার্তার ডামি তৈরি করা। এইধরনের টেলিগ্রাম সিগন্যালে কোড ল্যাঙ্গুয়েজে কথাবার্তা হত। নাৎসি বাহিনী যখন সেই সিগন্যাল ট্র্যাক করত, তখন মনে করত সত্যিই হয়তো মার্কিন বাহিনী কোনো গোপন অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু আসলে পুরোটাই ছিল তাঁদের বিভ্রান্ত করার কারসাজি।
আজ থেকে ৭৫ বছর আগে শেষ হয়ে গিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবথেকে প্রাণঘাতী যুদ্ধ। অবশ্য যুদ্ধে ছলনার প্রথা দীর্ঘকাল থেকেই চালু ছিল। পরেও দেখা গিয়েছে নানা সময়ে। কিন্তু এভাবে সামগ্রিক শিল্পের স্তর নিয়ে যাওয়ার কাজটা হয়তো আর হয়নি। হিরোসিমা-নাগাশাকির মর্মান্তিক পরিণতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা দিক তুলে ধরে ঠিকই। কিন্তু প্রত্যেক মুদ্রার তো অপর পিঠ থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এমন মজার ঘটনাও ভুলে যাওয়ার নয়।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বুকে বিঁধেছে গুলি, তবুও সংবাদ পৌঁছে দিয়ে বিশ্বযুদ্ধে ২০০ সেনাকে বাঁচিয়েছিল এই পায়রা