দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান সৈনিক, এই কথাটা শুনলেই নিশ্চই চোখের সামনে ভেসে উঠবে কোনো নাৎসির চেহারা। ইহুদিদের উপর তো বটেই, যে কোনো শত্রুর উপর তাদের নৃশংস অত্যাচার আজও কিংবদন্তি। তবে যদি বলা হয় এমন এক যুদ্ধের কথা, যেখানে জার্মান সৈনিকদের হাতেই পরাজিত হয়েছিল নাৎসি বাহিনী! অবশ্য সেই যুদ্ধে সামিল ছিলেন আমেরিকা এবং ফ্রান্সের সেনারাও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একবারই এই তিন দেশের সৈনিকরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। আর তাও নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে।
সময়টা ১৯৪৫ সাল। মে মাসের একেবারে গোড়ার দিক। ততদিনে নাৎসি বাহিনী একেবারেই বিপর্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি প্রায় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। সদ্য আত্মহত্যা করেছেন অ্যাডলফ হিটলার। তবে নাৎসি বাহিনী তখনও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই সময়েই ঘটল সেই অঘটন। যে যুদ্ধ ইতিহাসে ‘স্ক্লস ইটারের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। যে স্ক্লস ইটার ছিল নাৎসিদের অন্যতম প্রধান একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। ১৯৪৩ সালে আলপস পর্বতের উপর এই দুর্গ হয়ে উঠেছিল এক ভিআইপি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। সেখানে বন্দিদের মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সের দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড দালাদিয়ার এবং পল রেনোয়েড।
ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অংশ হিসাবে তৈরি হওয়া এই ক্যাম্প থেকে রক্ষীরা পালিয়ে যায় হিটলারের আত্মহত্যার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু বন্দিদের মুক্তির কোনো ব্যবস্থাই করা হয়নি। খবর পেয়ে সামান্য কয়েকজন সেনা পাঠায় ফরাসি বাহিনী। যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনাই তো আশঙ্কা করেননি কেউ। তবে এর মধ্যেই নতুন করে প্রস্তুতি নিয়ে দুর্গ অবরোধ করে নাৎসি বাহিনী। আর সেই বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা সামান্য কয়েকজন ফরাসি সৈনিকের ছিল না।
তবে এই সময়েই সবাইকে চমকে দিয়ে এগিয়ে এলেন এক জার্মান সেনা। তাঁর নাম জোসেফ গ্যাঙ্গল। একটি সাদা পতাকা নিয়ে পাশের মার্কিন শিবিরে পৌঁছে গেলেন গ্যাঙ্গল। শত্রুপক্ষের সদস্য হলেও তাঁর হাতে সাদা পতাকা, তাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন না মার্কিন সেনারা। বরং সব শুনে ঠিক করলেন তাঁর সঙ্গেই রওয়ানা হবেন ক্লস ইটারের উদ্দেশে। একটি আস্ত মার্কিন বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন জার্মান সেনা গ্যাঙ্গল।
আরও পড়ুন
জার্মানিতে এখনও লুকিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১ লক্ষ ঘাতক!
ক্লস ইটারের সামনে শুরু হল ধুন্ধুমার যুদ্ধ। মার্কিন ও ফরাসি বাহিনীদের প্রায় নাস্তানাবুদ করে ফেলেছিল নাৎসি বাহিনী। তবে ঠিক এই সময়েই গ্যাঙ্গলের নেতৃত্বে বেশ কিছু জার্মান সেনা যোগ দিলেন মিত্রশক্তির শিবিরে। এবার যুদ্ধের সমীকরণ বদলে গেল। এমনকি নাৎসিদের অত্যাধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জামও ব্যবহার করা হল নাৎসিদেরই বিরুদ্ধে। অবশেষে ৫ মে ক্লস ইটারের দরজা খুলে গেল। মুক্তি পেলেন সমস্ত যুদ্ধবন্দি। তবে এই সাফল্যের অন্যতম কাণ্ডারি জোসেফ গ্যাঙ্গল তখন মৃত্যুশয্যায়।
ক্লস ইটারের যুদ্ধ আসলে চরম বাস্তবতার কথাই জানিয়ে যায়। যেখানে রাষ্ট্র এবং দেশ আলাদা হয়ে যায়। দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রপ্রেম আর সমার্থক থাকে না। আর দেশ কখনও রাষ্ট্রের মতো আগ্রাসী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে না বলেই জোসেফ গ্যাঙ্গলের মতো সৈনিকরা লড়ে যেতে পারেন নিজেদের জীবন বাজি রেখে। ইতিহাসের বুক থেকে যে জার্মানির কলঙ্ক সরাতে হবে। একজন দেশপ্রেমিক হিসাবে সেটাই তখন তাঁর দায়িত্ব।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের অদ্ভুত ঘটনা; একটি সামান্য ‘টয়লেট’ ধরিয়ে দিল জার্মান সাবমেরিনকে!
Powered by Froala Editor