ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় সেটা। ইউরোপের কিংবদন্তি ফুটবল ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ তখনও দ্বিতীয় ডিভিশন ফুটবল লিগের সদস্য। ফার্স্ট ডিভিশন বুনদেশলিগা খেলা তো দূরের কথা, দ্বিতীয় ডিভিশনে প্রথম তিনের মধ্যে নিজের জায়গা ধরে রাখাও সেসময় বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল বায়ার্নের কাছে। ঠিক এমন একটা টালমাটাল সময়েই দলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি। চেহারাও খানিক স্থূলকায়। তবুও স্থানীয় ক্লাবে এক কথায় গোলের বন্যা বইয়ে দেওয়ার জন্যই তাঁকে দলে টেনেছিলেন বায়ার্নের কর্তারা। যদিও মূল কারণ ছিল ভিন্ন। স্থানীয় ক্লাব থেকে খেলোয়াড় কেনায় বড়ো অঙ্কের ট্রান্সফার ফি গুনতে হবে না ক্লাবকে।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে গার্ড মুলারকে নিয়েই। দ্বিতীয় বিশ্বকাপজয়ী জার্মান দলের অন্যতম শক্তিশালী গুটি ছিলেন তিনিই। অবশ্য জার্মানি বলা ভুল হবে। কারণ, তখনও দণ্ডায়মান বার্লিন ওয়াল। বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানি দ্বিবিভক্ত। ঠিক এমন একটা সময়ে ফুটবলকে হাতিয়ার করে বিশ্বের দরবারে পুনরায় জায়গা করে নিয়েছিল পশ্চিম জার্মানি। আর সেই সোনালি সময়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন গার্ড মুলার। ২০১৫ সাল থেকেই দূরারোগ্য অ্যালজাইমারে ভুগছিলেন তিনি। অবশেষে গতকাল ৭৫ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন জার্মানির সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার।
তবে সত্তরের দশকে পেনাল্টি বক্সজুড়ে তাঁর রাজত্ব চললেও, অশৈশব অনটনের সঙ্গেই লড়াই চলেছে গার্ড মুলারের। জন্ম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই। সেসময় ধ্বসে পড়েছে গোটা জার্মানির অর্থনীতি। নর্ডিঞ্জেন শহর এককথায় ধ্বংসস্তূপ। বিনোদন তো বটেই, এমনকি শিক্ষার ব্যবস্থার পরিকাঠামোও ভেঙে পড়েছিল তাসের ঘরের মতোই। সেসময় তাঁর কাছে একমাত্র ফুটবলই ছিল দম নেওয়ার সামান্য ফুরসৎ। পেশাদার ফুটবলে শুরুয়াত হয়েছিল স্থানীয় ক্লাব ‘১৮৬১ নর্ডিঞ্জেন’-এর জুনিয়র দলের হাত ধরে। তারপর মাত্র ১৭ বছর বয়সে মূল দলে খেলার সুযোগ। সেখান থেকে যাত্রা বায়ার্ন মিউনিখের পথে।
তবে বায়ার্নে কেরিয়ারের শুরুর দিকটা খুব একটা সুখকর ছিল না গার্ড মুলারের। স্থূলতা এবং উচ্চতার জন্য তাঁকে বুলিং-এর শিকার হতে হয়েছিল খোদ বায়ার্ন মিউনিখ কোচের। বাদ থাকেনি দর্শকদের কটূক্তিও। ‘ইনসিওরেন্স কোম্পানির এজেন্টকে স্বাক্ষর করিয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ’— পশ্চিম জার্মানিজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এমনই গুজব। নীরবেই তার উত্তর দিয়েছিলেন মুলার। দক্ষতার অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিলেন সবুজ ঘাসের মাঠে। শুরুর বেশ কয়েকটা ম্যাচে তাঁর ঠিকানা ছিল রিজার্ভ বেঞ্চ। তারপর সুযোগ আসে পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসাবে মাঠে নামার।
আরও পড়ুন
আরবি ইতিহাসের ছোঁয়ায় সেজে উঠছে ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের মঞ্চ
শুরু ম্যাচেই গোল দিয়ে শুরু করেছিলেন যাত্রা পথ। তারপর গোটা মরশুমে মাত্র ২৬টি ম্যাচ খেলে ৩৩টি গোল। তৎকালীন সময়ে যা বায়ার্নের ইতিহাসে ছিল রেকর্ড। হ্যাঁ, সেবার বায়ার্নের সেকেন্ড ডিভিশন লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যে ছিলেন তিনিই। আর সেই সুবাদেই প্রথম ডিভিশন বুন্দেশলিগায় খেলার সুযোগ এসেছিল বায়ার্ন মিউনিখের। দলে তখন মুলারের পাশে আরেক কিংবদন্তি খেলোয়াড় বেকেনবাওয়ার। দুই তরুণ তারকার যুগলবন্দিই বদলে দিয়েছিল জার্মান ফুটবল ক্লাবটির আবহ। বুনদেশলিগার শিরোপা আসে তার মাত্র তিন বছরের মাথায়। ১৯৬৮-৬৯ এর মরশুম সেটা। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বায়ার্নকে। পরবর্তী ৫টি বুনদেশলিগার মধ্যে ৪টে লিগ টাইটেল মুঠোবন্দি করেছিল জার্মান ক্লাবটি। ’৭২ সাল থেকে বায়ার্নের পর পর তিন বার ইউরোপিয়ান খেতাবজয়েরও নায়ক তিনিই।
আরও পড়ুন
৬০ মিনিটের ফুটবল ম্যাচ, নতুন নিয়ম আনতে চলেছে ফিফা?
ক্লাবসাফল্য তো বটেই, অ্যালিয়ান্স অ্যারেনায় ১৪ বছরে ফুটবল কেরিয়ারে মুলারের ব্যক্তিগর সাফল্যও তাজ্জব বনে যাওয়ার মতো। ৪২৭টি ম্যাচে ৩৬৫ গোল। আজও যে রেকর্ড অক্ষত রয়েছে তাঁরই নামে। একটি মরশুমে সর্বোচ্চ ৪০ গোলের রেকর্ডও ২০২১ সালে আগে পর্যন্ত ছিল তাঁর দখলেই। কিছুদিন আগেই ৪১ গোল করে মুলারকে ছাপিয়ে যান বায়ার্ন তারকা রবার্ট লিওনডস্কি।
আরও পড়ুন
আর ফুটবল নয়, সব ফর্ম্যাট থেকে অবসর ডাচ তারকা রবেনের
দেশের হয়েও এই একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন মুলার। ৬২ ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির হয়ে করেছিলেন ৬৮টি গোল। যার মধ্যে রয়েছ ১৯৭৪-এর বিশ্বকাপের ফাইনালে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর ঝকঝকে ফিনিশ। যে রেকর্ড স্পর্শ করতে পরবর্তী মিরোস্লাভে ক্লোজের লেগেছিল ১৩২টি ম্যাচ। আশ্চর্যের বিষয়, ১৯৭৪ সালের সেই ফাইনালই ছিল আন্তর্জাতিক জার্সিতে তাঁর খেলা শেষ ম্যাচ। তারপরই সকলকে অবাক করে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য ক্লাব ফুটবলে ইতি পড়ে আরও বছর সাতেক পরে।
না, তেমন কোনো ছক ভাঙা ফুটবলার হয়ে উঠতে পারেননি মুলার, পাননি মারাদোনার মতো সম্মান-রাজত্বও। তবে গোলখিদেই সকলের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল তাঁকে। “স্ট্রাইকার হিসাবে মুলারের সমতুল্য খেলোয়াড় আজও জন্মায়নি গোটা পৃথিবীতে। মুলার পেনাল্টি বক্সের মহম্মদ আলি”, মুলারের কৃতিত্বের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ২০১৫ সালে জানিয়েছিলেন সতীর্থ কার্ল-হেঞ্জ।
কিন্তু খেলা ছাড়ার পর বিশৃঙ্খল জীবন, মাদকাসক্তি ক্রমশ যেন গ্রাস করে নেয় মুলারকে। উপার্জনের তাগিদে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে খোলেন একটি রেস্তোরাঁ। কিন্তু সেই ব্যবসা চলেনি খুব একটা। বরং পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অবসাদ। ক্রমেই মুলার তলিয়ে গেছেন অ্যালকোহলের নেশায়। শেষে ফিরে আসার চেষ্টা করলেও সায় দেয়নি শরীর। কোচ হিসাবে মাঠে নেমেও সাফল্য মেলেনি তেমন। শেষ বয়সে এই লড়াই আরও কঠিন করে তোলে অ্যালজাইমার।
যেখান থেকে লড়াইটা শুরু হয়েছিল, শেষ বয়সে সেই জায়গাটাতেই যেন ফিরে গিয়েছিলেন ‘ডার বোমার’। সেই অনটন, অস্থির সময়ের স্মৃতি— সবই যেন ছায়ার মতোই ফিরে ফিরে আসত তাঁর সামনে। সেই বেড়াজাল ভেঙেই যেন অনন্তের পেন্টাল্টি বক্সের বুকে ঢুকে পড়লেন মুলার। চলে গেলেন সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু রেখে গেলেন একজীবন বিস্ময় আর ম্যাজিক। যা এককথায় রূপকথাই…
Powered by Froala Editor