সতেরো শতকের শুরুর দিকের কথা। পারস্য তথা অধুনা ইরানের সম্রাট তখন প্রথম শাহ আব্বাস। কারাবাঘ, আজারবাইজান, কুর্দিস্থান, লুরিস্থান-সহ মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক রাজ্যই সেসময় নিজের দখলে এনেছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ পারস্যরাজ। সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি জর্জিয়াও। তবে শুধু রাজ্যদখলই নয়, বরং জর্জিয়ার রানি কেটভানকেও বন্দি করে এনেছিলেন শাহ আব্বাস। ইরানের দক্ষিণে সিরাজ শহরে দীর্ঘ ১০ বছর তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখার পর শেষ অবধি তাঁকে হত্যা করেন তিনি। কারণ, হাজার চেষ্টাতেও সম্ভব হয়নি ধর্মান্তকরণ।
তবে রানি কেটভানের দেহ ইরানে নয়, বরং তা এতদিন লুকিয়ে ছিল ভারতে! দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর বছর কয়েক আগে ভারতীয় গবেষক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রচেষ্টায় খুঁজে বার করা সম্ভব হয়েছিল সেই দেহাংশ। সম্প্রতি দু’দিনের জর্জিয়া সফরে গিয়ে সেই প্রত্নতাত্ত্বিক স্মৃতিচিহ্ন জর্জিয়া সরকারের হাতে তুলে দিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান থেকে ভারতে এসে পৌঁছাল রানির মৃতদেহ? বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি জানায়, কেটভানের মৃত্যুর এক বছর আগে সিরাজ-ভ্রমণে গিয়ে রানির দেখা পেয়েছিলেন তিন অগাস্টিয়ান পুরোহিত। তাঁদের কাছেই রানি অনুরোধ করেছিলেন, যেন মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অন্যত্র। ১৬২৪ থেকে ১৬২৭ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনে সেই কাজটাই করেছিলেন তাঁরা। ততদিনে পর্তুগিজ নাবিকরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন ভারতের পথ। সেই পথে জাহাজে চেপে বাক্সবন্দি হয়ে তাঁর দেহ এসে পৌঁছায় ভারতে।
তবে দেহ না বলে, দেহাংশ বলাই ভালো। কারণ, রানির সম্পূর্ণ দেহকে বেশ কয়েকটি খণ্ড করে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সমাধিস্থ করেছিলেন অগাস্টিয়ান পণ্ডিতত্রয়। ভারতে এসেছিল কেবলমাত্র একটি খণ্ড। আর তা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল গোয়ার সেন্ট অগাস্টিয়ান গির্জায়।
আরও পড়ুন
‘অস্পৃশ্য’ রানি-কে ডুবন্ত দেখেও বাঁচাল না কেউ; সাড়ম্বরে পালিত হল অন্ত্যেষ্টি
সত্তরের দশকের শেষের দিকে ভারত সরকারের কাছে সেই প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন অনুসন্ধানের আবেদন করেন জর্জিয়ার প্রশাসন। ১৯৮০ সালেই শুরু হয়েছিল ‘তদন্ত’। তবে খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা। কারণ, বিগত চারশো বছরে একাধিকবার সংস্করণ হয়েছে গোয়ার সেই গির্জার। ফলত নির্দিষ্ট অবস্থান খুঁজে বার করাই ছিল বেশ দুঃসাধ্য কাজ।
আরও পড়ুন
ডাক পেয়েছেন রানি এলিজাবেথের থেকেও, বাঙালিই মনে রাখেনি বিজ্ঞানী মাধবচন্দ্র নাথ-কে
২০০৪ সালে প্রথম রহস্যভেদ করেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিকরা। উন্নত প্রযুক্তির স্ক্যানারের মাধ্যমে খুঁজে পান চার্চের তলায় সমাধিস্থ একটি বাক্স। তা থেকে মেলে হাতের একটি দীর্ঘ হাড়। সেইসঙ্গে খননকার্যের সময় আরও দুটি হাড় উদ্ধার করেন গবেষকরা। তবে এই হাড় যে রানিরই দেহাংশ, তা প্রমাণ করাই ছিল সবথেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ। এস্টোনিয়ান বায়োসেন্টার এবং সিসিএমবি’র গবেষকরা পরবর্তীতে জিন টেকনোলজির মাধ্যমে সমাধান করেন সেই রহস্যের। সেই অস্থি থেকে মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনের একটি সিকোয়েন্স তৈরি করেছিলেন তাঁরা। ২২ হাজার নমুনা মিলিয়ে দেখার পর, আসে সাফল্য। খুঁজে পাওয়া যায় জর্জিয়ান জিনের সূত্র।
আরও পড়ুন
মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে রাখি পাঠালেন রাজপুত রানি কর্ণাবতী, সাড়া দিলেন সম্রাটও
২০১৪ সালে এই রহস্যের সমাধান সম্ভব হলেও, তারপর কেটে গেছে আরও সাত বছর। প্রশাসনিক কার্যকলাপের জন্য সেই দেহাংশ পাঠানো সম্ভব হয়নি জর্জিয়াতে। এবার বিদেশ সফরে গিয়ে স্বয়ং সেই স্মৃতিচিহ্ন জর্জিয়া সরকারের হাতে তুলে দিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী। পাশাপাশি সুপ্রতিষ্ঠিত হল ইতিহাসের একটি অধ্যায়ও। কারণ হাজার পুঁথিগত প্রমাণ থাকলেও রানিহত্যার কথা এতদিন পর্যন্ত অস্বীকার করে এসছিল ইরান। এবার প্রযুক্তির দৌলতে সম্ভব হল সেই শূন্যস্থান পূরণ…
Powered by Froala Editor