মাথায় বিদ্যুৎ দিয়ে ‘হত্যা’, মিথ্যা অভিযোগে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল এই কৃষ্ণাঙ্গ বালকের

কাঠের চেয়ারে বসে একটি ১৪ বছরের বালক। হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। মাথার উপরে একটা ধাতব হেলমেট। দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারে ঝুলছে ১৯৪৪ সালের জুন মাসের পাতা। এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করে নেওয়া খুব কঠিন নয়। এরপর একটা স্যুইচ টিপতেই বালকটির মাথা ঝনঝন করে উঠল। ধাতব হেলমেটের ভিতর দিয়ে তখন চলেছে বিদ্যুৎ প্রবাহ। সেই বিদ্যুৎ ধীরে ধীরে বালকটির প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পর সব শান্ত। মাথাটা প্রায় পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। একটি দাঁতও আর অবশিষ্ট নেই। ঠিক এভাবেই মৃত্যু হয়েছিল জর্জ স্টিনি জুনিয়রের। আমেরিকা তো বটেই, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কনিষ্ঠ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী সে। তার অপরাধ, সে আমেরিকায় জন্মেছিল কিন্তু চামড়ার রং ছিল কালো। অর্থাৎ যাকে বলে নিগ্রো, বা মার্কিন দাঁতচাপা ইংরেজিতে নিগার।

বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। তার আগে একটু সূত্র ধরিয়ে দেওয়া যাক। জর্জ স্টিনির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দুটি খুন এবং একটি ধর্ষণের চেষ্টার। তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে লেগেছিল মাত্র ১০ মিনিট। কিন্তু নির্দোষ প্রমান করতে লেগে গিয়েছে ৭০ বছর। ৭০ বছর পর তার অপরাধ অপ্রমানিত হলেও কিছু যায় আসেনা। কারণ অকালে ঝরে যাওয়া প্রাণটা আর ফিরে আসেনি। শুধু বিচারের নামে একটা প্রহসন উন্মোচিত হয়েছে সমস্ত পৃথিবীর সামনে।

১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণ ক্যারোলিনা অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যায় দুই সাদা চামড়ার বালিকার মৃতদেহ। বেটি বিনিকার, বয়স ১১ এবং মেরি এমা, বয়স ৮। তদন্তে নেমে পুলিশের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল খুনীকে খুঁজে বের করা। আর একরকম অপ্রত্যাশিতভাবেই আসামীকে পেয়ে গেল পুলিশ। ঘটনাস্থলের পাশেই থাকে একটি কালো চামড়ার পরিবার। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর আগে সেই পরিবারের ছোট ছেলেটির সঙ্গে দেখাও হয় মেয়ে দুটির। তারা তাকে একটি ফুল গাছের সন্ধান জিজ্ঞেস করে। একথা ছেলেটি নিজেই স্বীকার করেছে। অতএব দুয়ে দুয়ে চার করতে বেশি সময় লাগল না। দুমাস ধরে বিনা বিচারে আটকে রাখা হল জর্জ স্টিনিকে। এমনকি তার পরিবারের কারোর সঙ্গে দেখা করতেও দেওয়া হল না। দুমাস পর পেশ করা হল চার্জশিট। বিচার চলল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। জর্জকে দোষী সাব্যস্ত করতে জুরিদের সময় লাগল মাত্র ১০ মিনিট। আর একজন তখন আমেরিকায় একজন সাদা চামড়ার মানুষ অসংখ্য কালো চামড়ার মানুষকে হত্যা করেও নিষ্কৃতি পেতে পারত। কিন্তু কালো চামড়ার কেউ সাদা চামড়ার কারোর সঙ্গে জোর গলায় কথা বললেও যে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। অতএব মানবাধিকার সংগঠন এবং শিশু সুরক্ষা সংগঠনগুলির একাধিক অনুরোধের পরেও শাস্তির ব্যাপারে অনড় বিচারক। জর্জকে দেওয়া হল মৃত্যুদণ্ড।

১৯৪৪ সালে বিচারের নামে যে প্রহসন চলেছিল, তারও যবনিকা উন্মোচন হল ৭০ বছর পর। ২০০৯ সালে এক আইনজীবী কেসটা রি-ওপেন করলে পাঁচ বছর ধরে চলেছিল মামলা। এবারে কিন্তু জর্জের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই দাখিল করা গেল না। এবং আশ্চর্যের বিষয়, দেখা গেল ৭০ বছর আগেও ছিল না কোনো প্রমাণ। এমনকি জর্জের স্বীকারোক্তি বলে যে বয়ান পেশ করা হয়েছিল, সেটিও ভুয়ো বলে প্রমাণিত হল। বরং বিচারের শেষে প্রমাণ হল দুই বালিকার মৃত্যুর সময় জর্জ তার ছোটো বোনের সঙ্গেই ছিল। তাহলে অপরাধী কে? ৭০ বছর পর এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে ঘটনার পর তদন্ত সঠিক পথে এগোলে হয়তো অপরাধীর সন্ধান পাওয়া যেত। কিন্তু পুলিশ তো কোনো সংশয় রাখেনি। আমেরিকার মাটিতে কালো চামড়া নিয়ে জন্মানোর চেয়ে বড়ো অপরাধ আর আছে? আজও তো জর্জ ফ্লয়েডকে মরতে হয় একই অপরাধে। শুধু এখন সেই ঘটনার প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নামে। সাদা চামড়ার পুলিশের নিন্দায় সরব হয় অন্য সাদা চামড়ার পুলিশরাই। কিন্তু ১৯৪৪ সালে সবাই নিরবে মেনে নিয়েছিল জর্জ স্টিনির মৃত্যুদণ্ড। শুধু তার বাবা-মা এবং ভাই-বোনের চোখ দিয়ে কয়েকটা অসহায় অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়েছিল। অন্ধ বিচারের খাতায় তার হিসাব লেখা হয়নি।

আরও পড়ুন
জর্জ ফ্লয়েডের অন্তিমযাত্রায় সঙ্গ দিলেন প্রতিবাদীরা, শোকজ্ঞাপন গোটা আমেরিকার

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ – বর্ণবৈষম্য মুছে আমেরিকাকে ‘মানুষ’ করতে চেয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং

More From Author See More