জর্জের বয়স তখন সবে এগারো। বাবার সঙ্গে ঘুরতে গেছে বাবার বন্ধুর বাড়ি। জর্জের বাবা অ্যালেক্সি রেমি মিঠাইয়ের দোকানের সামান্য কর্মচারী হলেও তাঁর এই বন্ধু বেজায় বড়লোক। নাম পল ফন কুটসেম, পেশায় নামকরা স্থপতি। পলের স্ত্রী ইরমা নাকি এক কাউন্টেস পরিবারের মেয়ে। বাড়িতে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ছোট্ট জর্জের। এত বড়ো বাড়ি সে আগে কোনদিন দেখেনি। তবে বাড়ির চেয়েও যাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারল না, সে এক ছোট্ট ঝুঁটি বাঁধা মিষ্টি কন্যে। নাম মারি লুই ফন কুটসেম। “কি নামে ডাকব তোমায়?” জিজ্ঞেস করল জর্জ।
“সবাই আমায় মিলু বলে ডাকে” একগাল হেসে জবাব দিল মেয়েটা।
সেই শুরু। এগারো বছরের একহারা চেহারার জর্জ আর তেরো বছরের শান্তশিষ্ট মিলুর বন্ধুত্ব জমে উঠল। প্রায়ই দুজনে মিলে হাঁটতে যেত বিকেলবেলায়। জর্জকে ভালবেসে মারি ডাকত জিও বলে। জিও আর মিলু যেন অবিচ্ছেদ্য দুই আত্মা। স্কুল পালিয়ে কাউকে না জানিয়ে গিয়ে বসে থাকে বয় দেলা কোয়াঁর পার্কে। সেবার মিলুর জন্মদিনে জর্জ একটা কবিতার বই উপহার দিল। প্রথম পাতাতেই এঁকে দিল অদ্ভুত এক ছবি। এক লম্বা কানওয়ালা খরগোস এক মুরগির ডিম ভেঙে দিয়েছে। মোরগ তাই তাঁকে খুব বকা দিচ্ছে। তলায় লেখা “To my girlfriend Marie-Louise, Georges Rémi, 1918"। নিচে তেড়াবেঁকা অক্ষরে নতুন মকশো করা সই Herge. আসলে জর্জ রেমির J.R. কে উলটে লিখলে যা হয় আর কি। বই আর ছবি পেয়ে দারুণ খুশি মিলু। সেই জর্জকে বলল আরও মন দিয়ে ছবি আঁকা চালিয়ে যেতে। ১৯২০ সালে আবার মারির জন্মদিনে এক ছবি আঁকা কবিতার বই উপহার দিল জর্জ। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জর্জের ছবিতে তাই এক পিছনে ফেরা সৈন্য। এবার অবশ্য ‘গার্লফ্রেন্ড’ না লিখে ‘ডিয়ার ফ্রেন্ড’ লিখেই সন্তুষ্ট জর্জ।
সময় কাটতে লাগল। দুই পরিবার আরও ঘনিষ্ট হল পরস্পরের। কিন্তু বাবা মায়েরা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি আপাত বন্ধুতার আড়ালে জর্জ আর মিলুর মধ্যে অন্যকিছু একটা গড়ে উঠেছে, যাকে লোকে প্রেম বলে ডাকে। তখন প্রায়ই দুজনে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যেত। ছবি তুলত একসঙ্গে। মিলুর কথা শুনেই জর্জ "Belgian Boy Scout", "Le Blè qui Lève" এর মত পত্রিকায় ছবি আঁকা শুরু করেছে। ইতিউতি বেশ নামডাকও হচ্ছে তাঁর। ১৯২৪ সালে পড়াশুনোর পাট চুকালো জর্জ। দারুণ রেজাল্ট। সবমিলিয়ে একাশি শতাংশ। কিন্তু জর্জের মন খারাপ। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় আঁকাতেই নাকি সে ২০তে মাত্র ৯ পেয়েছে। দাদা পল-ও তাঁর থেকে বেশি। মাস্টারমশাই জানিয়েছেন, জর্জের ছবি নাকি ঠিক কনভেনশনাল না, কেমনতর। এতে বেশি নম্বর দেওয়াই যায় না। কাঁদতে বসল জর্জ। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করল মিলু। জর্জ চাকরি নিল সংবাদপত্রের অফিসে। মিলু ঠিক করল বাবা মাকে এবার সব জানিয়ে দেবার সময় এসেছে।
পল আর ইরমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এই মিঠাইওয়ালার আঁকিয়ে ছেলের সঙ্গে তাঁদের মেয়ে বিয়ে! অসম্ভব! ইরমা তো বলেই দিলেন, “এ ছেলে টেবিলক্লথে ছবি আঁকারও যোগ্য না।” জর্জের সঙ্গে মিলুর মেলামেশা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হল। একেবারে রোমান্টিক সিনেমার প্লট। কিন্তু সিনেমায় যেমন হয় বাস্তবে কি তাই ঘটে? মায়ের কথা মেনে নিল মিলু। আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে এতদিনের চাকরি ছেড়ে ফাদার ওয়ালজ-এর XXème siècle চাকরি নিল জর্জ। ‘অ্যার্জে’ নামে আঁকতে শুরু করল ছোটো ছোটো কার্টুন। এর মধ্যেই ফাদার ওয়ালেস তাঁকে দায়িত্ব দিলেন সেই কাগজেরই ছোটোদের ক্রোড়পত্র ল্য পেতি ভিন্তেমে এক নতুন কমিকস সিরিজ শুরু করতে। ক্যাথলিক আদর্শে গড়ে ওঠা এই পত্রিকা ছিল আদ্যন্ত কম্যুনিষ্ট বিরোধী। তাই ফাদার জর্জকে দায়িত্ব দিলেন এমন এক কমিকস আঁকতে যা বাচ্চাদের মনে কম্যুনিজম নিয়ে দারুণ ঘৃণা জন্মাবে। ফলে ক্যাথলিক আর বয় স্কাউট আদর্শে দীক্ষিত জর্জ অনেকটা নিজের আদলে এক সাংবাদিক চরিত্র বানালেন। নাম দিলেন ত্যাত্যাঁ।
আরও পড়ুন
মিম-সংস্কৃতির হাত ধরে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে বাংলা সাহিত্যও?
কিন্তু হোমসের যেমন ওয়াটসন, ফেলুদার যেমন তোপসে, এই ত্যাত্যাঁ বা টিনটিনের সঙ্গী কে হবেন? মনে এল বান্ধবী মিলুর কথা। জর্জ তো সঙ্গী হিসেবে তাঁকে ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারে না। কিন্তু বাচ্চাদের পত্রিকায় ওসব চলবে না। তাই এল ছোট্ট দুধসাদা আদুরে এক কুকুরছানা, নাম মিলু। ইংরাজি অনুবাদে স্নোয়ি বা বাংলায় কুট্টুস হয়ে যাওয়ায় জর্জের এই ট্রিবিউটটা প্রায় হারিয়েই গেছে। তবে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে দুজনে যেমন গল্প করত, টিনটিন আর মিলুও তেমনি করে। অ্যার্জে নিজে বলেছেন”"Snowy is always there alongside Tintin. They talk to each other. Even though he speaks, Snowy is above all just a normal dog. Even though he talks a great deal, he remains a simple dog for Tintin. Tintin and Snowy are totally on the same wavelength even when they are in conversation". টিনটিনের একেবারে বাস্তব জগতে এই অবাস্তবতা আমরা দেখেও দেখি না।
প্রতিটা টিনটিনের বই প্রকাশ পেলে নিজে এক কপি মিলুকে পাঠাতেন তাঁর জিও। ততদিনে সে বিবাহিত। জর্জও ভালবেসে ফেলেছে ফাদার নোবার্টের বুদ্ধিমান সেক্রেটারি জারমেইনকে। ১৯৩৯ সালে বরের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি দিল মিলু। সেই থেকে জর্জের সঙ্গে সম্পর্কও ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। যোগাযোগ নেই অনেক বছর। ১৯৫২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসের আর্ট গ্যালারিতে কালো সোনার দেশে - বইতে সই দিচ্ছিলেন ততদিনে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া ‘অ্যার্জে’। সামনে লম্বা লাইন। লাইনে হঠাৎ একটা চেনা মুখ দেখে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। চেয়ার উলটে গেল। মিলু না! প্রায় চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন কৈশোরের প্রেমকে। সাতাশ বছর পরে সত্যিই সেদিন মিলু এসেছে জিওর সই নিতে। সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ জানতেন এই ঘটনা। তাঁদের কারও চোখ সেদিন শুকনো ছিল না।
আরও পড়ুন
কমিক্সের বই থেকে সোশ্যাল মিডিয়া; নতুন প্রজন্মের হাত ধরে মিমের জগতেও উজ্জ্বল টিনটিন
১৯৭৪ সালের ৩০ এপ্রিল জর্জের বাড়িতে ফোন এল। মিলুর ছেলের বউ জানিয়েছে মিলু আর নেই। সেই ফোন অ্যার্জে ধরতে পারেননি। ব্রাসেলসের বাইরে ছিলেন। ফিরে এসেই যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। যদি ফিউনেরালে যাওয়া যায়। ফোন বেজে গেল। শোকবার্তা পাঠালেন। পিওন যে চিঠি ফেরত নিয়ে এল। মিলুর পরিবার নাকি সেই ঠিকানা ছেড়ে কোথায় চলে গেছে। এর পরে টিনটিনের আর একটাই অভিযান প্রকাশ পায়। টিনটিন এন্ড দ্য পিকারোস। ব্যাস!
Powered by Froala Editor