এ যেন রূপকথার রাজ্য। কিংবা কোনো জাদু ছড়িয়ে আছে সমগ্র অঞ্চল জুড়ে। স্থানীয় মানুষদের অনেকেই বিশ্বাস করে সেই ধারণায়। আজ যেখানে ডাল খালি, হয়তো বছর কয়েকের মধ্যে ভর্তি হয়ে গেল। না, গাছের ডাল নয়। একটা গোটা হ্রদ। যার জল আচমকাই উধাও হয়ে যায়। আবার কিছু বছরের মধ্যে প্রবল গর্জনে এগিয়ে আসে স্থলভাগের দিকে। কিন্তু ‘হয় সে কেমন করে’ নিয়েই রহস্য অব্যাহত।
অস্ট্রেলিয়ার (Australia) ক্যানবেরা প্রদেশ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ৪০ কিলোমিটার পথ চললে সন্ধান পাওয়া যাবে জর্জ লেকের (George Lake)। তাকে নিয়েই যত কাহিনি। আপাতত হ্রদ বলে পরিচিত হলেও বছর দশেক আগেও পুরো জায়গাটা ছিল বিরাট এক মাঠের মতো। পূর্ণ হয়ে থাকত বড়ো বড়ো ঘাসে। এদিক-ওদিক ঘুরে বেরোয় তৃণভোজী পশুরা। ১৫৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়েই তখন এরকম অবস্থা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জর্জ লেক পৃথিবীর প্রাচীনতম হ্রদগুলির মধ্যে অন্যতম। কয়েক হাজার বছর আগে যার জন্ম। যদিও প্রথমে কিন্তু এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তখন ইয়াস নদী বয়ে যেত দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী পাদদেশ ধরে। তারপর একের পর এক ভূতাত্ত্বিক বিপর্যয়ে সম্পূর্ণ বদলে গেছে পরিবেশ। মাঝখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নিয়েছে জর্জ হ্রদ। ঘটনাচক্রে এই হ্রদের জল লবণাক্ত।
কিন্তু সেটার থেকেও বেশি আশ্চর্যের হল জর্জ হ্রদের মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা। উনিশ শতকের শুরুতে প্রথম মানুষের নজরে আসে এই অদ্ভুত কার্যকলাপ। তখন অবশ্য হ্রদের আয়তন এখনের থেকে অনেকটাই বেশি ছিল। কিন্তু ১৮৪০ সাল নাগাদ প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায় হ্রদের জল। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জনবসতি না থাকায় অতটা আলোচিত হয়নি বিষয়টি। যদিও স্থানীয় উপজাতিরা হ্রদের মধ্যবর্তী অংশ পর্যন্ত অনায়াসে চলে যেত পায়ে হেঁটে। তার বছর তিরিশ পরে ফের জলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে জর্জ হ্রদ। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহময়ী হয়ে ওঠে সমগ্র অঞ্চল। যার সূত্র ধরে আগমন ঘটে ‘হাওয়া বদল’-এ উৎসাহীদের। ক্রমে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেই বিখ্যাত হয়ে যায় জর্জ লেক। এমনিকে হ্রদে প্রমোদতরীর ব্যবস্থাও করতে থাকে অনেক সংস্থা।
আরও পড়ুন
জীবিত প্রাণীকে পাথরে পরিণত করে এই হ্রদ! কীভাবে?
কিন্তু প্রকৃতির লীলাখেলা বোঝা তাদের পক্ষে ছিল মুশকিল। বিশ শতকের শুরুতেই ফের ‘অদৃশ্য’ হয় হ্রদের জল। শুকনো, খটখটে স্থলভূমিতে ভিড় কমতে থাকে পর্যটকদের। অস্ট্রেলিয়ার ভূতত্ত্ববিদ প্যাট্রিক ডে ডেকের ১৯৭১ সালে প্রথম পর্যবেক্ষণ করতে যান জর্জ হ্রদের রহস্য। তখন কিন্তু হ্রদ জলে পরিপূর্ণ। কয়েক দশক আগেই গড়ে উঠেছে মৎস্যশিল্প। প্রতিদিন কয়েকশো মানুষ নৌকো ভাসায় মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। তাঁর গবেষণা অনুযায়ী ১৯৮৬-তে জলশূন্য হয়ে গেলেও ১৯৯৬-তে আবার ভর্তি হতে দেখা যায় হ্রদটিকে। পর্যায়ক্রমে একই বিষয় ঘটেছে ২০০২ ও ২০১৬-তে।
আরও পড়ুন
হ্রদের তলাদেশে আবিষ্কৃত ১৩০ বছরের পুরনো জাহাজের ‘মৃতদেহ’!
কিন্তু কেন ঘটনা ঘটে জর্জ হ্রদে? স্বাভাবিকভাবেই গজিয়ে উঠেছে অনেক রহস্য কাহিনি। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি হচ্ছে ক্যানবেরার এই হ্রদের জল কমে গেলে নিউজিল্যান্ডের কোনো এক হ্রদ ফুলে ফেঁপে ওঠে। অবশ্যই কোনো প্রমাণ নেই এই ঘটনার। বরং প্যাট্রিক তুলে আনছেন অন্য তত্ত্ব। তাঁর ব্যাখ্যায়, জর্জ লেকের নিচে সব সময়ই জল পরিপূর্ণ থাকে। এটি আসলে একটি অবনত ভূমি। বছরের পর বছর বৃষ্টির মাত্রা বৃদ্ধিতে তলদেশ থেকে উঠে আসে হ্রদের জল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এই অঞ্চলে প্রায়ই প্রবল ঝড় ওঠে। হ্রদের বিস্তৃতির কারণে এক প্রান্তের জল চলে যায় অন্যদিকে। অগভীরতার জন্য জলভাগে সামান্য পরিবর্তন হলেও তা নজর কাড়তে বাধ্য।
ব্যাখ্যা যাই থাক না কেন, জর্জ হ্রদের ‘অদৃশ্য’ হয়ে যাওয়া কিন্তু প্রকৃতির আশ্চর্য গতিপ্রকৃতির নমুনা। মানুষ তা দেখে বিস্মিত হতে পারে, বদলের এক্তিয়ার পায়নি কখনও।
Powered by Froala Editor