“চাঁদের পৃষ্ঠদেশে থেকে শেষ মানুষ হিসেবে পা তুলে নিচ্ছি। যেভাবে এসেছিলাম, সেভাবেই ফিরছি। ঈশ্বর সঙ্গে থাকলে আবার ফিরব। সমগ্র মানবজাতির পক্ষ থেকে এই কথা ঘোষণা করছি।”
অ্যাপোলো ১৭-র (Apollo 17) মই-এ ওঠার আগে এই কথাগুলি বলেছিলেন কমান্ডার জিন সারনান (Gene Cernan)। ততক্ষণে চন্দ্রযানে উঠে পড়েছেন হ্যারিসন স্মিট্। শেষ ৩ দিন চাঁদের মাটিতে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁদের। গান গেয়েছেন, মজা করেছেন। সংগ্রহ করেছেন চাঁদের মাটি, পাথর। বিদায় মুহূর্তে চাঁদের আকাশের নিকষ কালো আঁধারে শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে জিন উঠে পড়লেন চন্দ্রযানে।
না, তাঁর ঘোষণা বাস্তবরূপ পায়নি। আর কোনোদিন চাঁদের বুকে মানুষের পা পড়েনি। নীল আর্মস্ট্রং-এ যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, জিন সারনান-এ এসে তার যবনিকা পড়ে। চাঁদের মাটিতে পৃথিবীর শেষতম মানুষের স্পর্শ থাকার বিরল কৃতিত্ব লেখা রইল জিন সারনানের নামে।
জিনের জন্ম ১৯৩৪ সালে আমেরিকার শিকাগো-তে। ইন্ডিয়ানার পার্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে যোগদান করেন আমেরিকার নেভি-তে। প্রায় ৫০০০ ঘন্টার বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। ১৯৬৩ থেকে ‘জেমিনি’ ও ‘অ্যাপোলো’ স্পেস-প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে কাজ শুরু করেন ‘নাসা’-র সঙ্গে। প্রথমে অবশ্য ছিলেন ‘বদলি’। কোনো মহাকাশযাত্রী অভিযানে অংশগ্রহণ করতে অপারগ হলে তবেই ডাক আসার সম্ভাবনা।
আরও পড়ুন
চাঁদে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের, কী হল শেষমেশ?
সেই সুযোগ এল অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে। ১৯৬৬-তে মহাকাশযানের মহড়া দিতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যান দুই প্রথম সারির বৈমানিক। সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে জিন-এর উপরে। ‘নাসা’-র ইতিহাসে প্রথমবার মহাকাশযাত্রার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ‘বদলি’ বৈমানিকের ভরসায়। কিন্তু প্রথম সুযোগেই বাজি মেরে দেন জিন। ‘জেমিনি ৯’-এ নিয়ে সফলভাবে পাড়ি দেন মহাকাশে। অবশ্য গোলযোগ বাধায় ‘নাসা’-র প্রযুক্তি। তাই শুধু মহাকাশ ছুঁয়েই ফিরে আসতে হয় ‘জিন’-কে। চাঁদ তখনও দূরের স্বপ্ন।
আরও পড়ুন
চাঁদ-মঙ্গলের পর এবার গ্রহাণুতেও শহর তৈরির পরিকল্পনা! নকশা বানালেন বিজ্ঞানীরা
১৯৬৯-এ আবার দরজা খুলে গেল তাঁর কাছে। এবার ‘অ্যাপোলো ১০’-এর ড্রেস রিহার্সাল। যেতে হবে চাঁদের কক্ষপথ পর্যন্ত। ঘুরে ঘুরে চাঁদের পরিবেশের তথ্য যোগাড় করতে হবে। যার উপর নির্ভর করে তৈরি হবে নীল আর্মস্ট্রং-দের ‘অ্যাপোলো ১১’-এর ভবিষ্যৎ। সারনান শুধু তথ্য এনে দেননি, চাঁদ থেকে ফেরার সময় ছুঁলেন মহাকাশযানগুলির মধ্যে গতির সর্বোচ্চ রেকর্ড।
চাঁদে নামা হল না এবারও, শুধু বুড়িছোঁয়া করে ফিরে আসা। আর তারপরই ঘনিয়ে আসে বিপদ। আচমকাই বাতিল হয়ে যায় ‘অ্যাপোলো ১৫’-এর পরিকল্পনা। ১৯৭০-এ বাতিল ‘অ্যাপোলো ১৯’। কারণ একটাই—অর্থ। আমেরিকা সরকার ‘নাসা’-র চন্দ্রাভিযানের পিছনে আর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে রাজি নয়। ততদিনে প্রায় অলিখিত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে যে আর চাঁদে মানুষ পাঠানো হবে না। এর আগে আমেরিকা চাঁদে বেশ কয়েকবার মানুষ পাঠিয়েছে। ব্যর্থও হয়েছে কয়েকটি পরিকল্পনা। ১৯৬৬-র পর থেকেই বাজেটে কাটছাঁট করতে শুরু করেছিল। আর প্রয়োজন নেই। এসবই নাকি ‘পাবলিক স্টান্ট’। ‘অ্যাপোলো ১৭’ মিশন নিয়েও ওঠে একের পর এক প্রশ্ন।
কিন্তু গোঁ ধরে বসে থাকেন হ্যারিসন স্মিট্। তাঁর জোরাজুরিতেই সফল হয় ‘অ্যাপোলো ১৭’-এর উৎক্ষেপণ। জিন-কেও বেছে নেন তিনিই। ১৯৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর। হ্যারিসন স্মিট্, রোনাল্ড ইভান্স ও জিন সারনান পাড়ি দিলেন চাঁদের উদ্দেশ্যে। শুরু হল যাত্রা। ১৪ ডিসেম্বর চাঁদের ‘ভ্যালি অফ টরাস লিট্রো’-তে পৌঁছোন তাঁরা। ১১ তম মানুষ হিসেবে চন্দ্রপৃষ্ঠে নামলেন জিন। তারপর হ্যারিসন। চন্দ্রযানটি নিয়ে ভেসে বেড়াতে থাকেন রোনাল্ড। অন্যদিকে তিনবার মহাকাশে ও দু-বার চাঁদে পৌঁছোনোর বিরল কৃতিত্ব অর্জন করলেন সারনান। আর সত্যিই এবার ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন সত্যি হল চাঁদের মাটিকে।
শিশুর মত খুশিতে মেতে ওঠেন দুজনে। জিন প্রস্তাব দেন, চলো একটু হাঁটা যাক। তাঁকে অনুসরণ করে হ্যারিসন। সাত ঘন্টা পরে ফেরার সময় খানিকটা পিছিয়ে পড়েন জিন। মজা করে বলেন, আগে গিয়ে তালা লাগিয়ে দিও না। তাহলে কিন্তু আমি বিপদে পড়ব।
তিনদিন পরে ফেরার পালা। জিন চাঁদের বুকে লিখলেন তাঁর মেয়ের নাম। কিংবদন্তি হয়ে যায় গল্পটি। রীতিমত গান তৈরি হয় ‘ট্র্যাসি রক’ নামের পাথরটি নিয়ে। পরে অবশ্য জিন জানান, পাথরে নয়, মাটিতেই নাম লিখেছিলেন তিনি। তারপর ধীর পায়ে ফিরে এলেন মহাকাশযানের দিকে। শেষবারের মতো চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে পা তুললেন জিন। তাঁর কৃতিত্বের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে যায় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। চাঁদের বুকে পৃথিবীর প্রথম মানুষ আর্মস্ট্রং ও শেষতম মানুষ জিন দুজনেই ছিলেন পার্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
জিন আশা করেছিলেন আবার ফিরবেন। পূর্ণ হয়নি সেই আশা। তারপর অনেক মহাকাশযান পৌঁছেছে চাঁদে। কিন্তু মানুষ নামেনি। চাঁদের বুকে মানব অস্তিত্বের শেষ পরিচয় রয়ে গেছে জিনের মেয়ের নামে।
Powered by Froala Editor