স্বাধীনতার একবছর আগেই উড়ে যেত গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া ও তাজ হোটেল

১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। বম্বে বন্দরে ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবাহিনীর ভারতীয় নাবিকরা, অর্থাৎ রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি (Royal Indian Navy) নিম্নমানের খাবারের প্রতিবাদে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। কয়েক মাস ধরে নৌসেনাদের এমন নিম্নমানের খাবার দেওয়া হচ্ছিল। তাঁদের প্রাতঃরাশের জন্য ডাল এবং দুটো রুটি এবং দুপুরে ওই একই ডালের সঙ্গে ভাত দেওয়া হত।

বন্দরের কাছেই ছিল কমিউনিকেশন ট্রেনিং সেন্টার। সেখানকার এইচএমআইএস তালওয়ারের নাবিকরা অবশেষে ধৈর্য হারান। তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন, 'খাবার নেই, কাজ নেই।' এমনকী ব্রিটিশ অফিসারদের আদেশ মানতেও অস্বীকার করেন তাঁরা। বিদ্রোহীরা এইচএমআইএস তালওয়ারের কমান্ডার আর্থার ফ্রেডরিক কিং-এর গাড়ির টায়ার পাংচার করে গাড়িতে 'ভারত ছাড়ো' এবং 'জয় হিন্দ' স্লোগান লেখার স্পর্ধা পর্যন্ত দেখান। 

বিদ্রোহের আগুন আগে থেকেই জ্বলছিল। আর এই ঘটনা আগুনে ঘি ঢালে। ভারতীয় নৌবাহিনী দিল্লির লালকেল্লায় ১৯৪৫-এর নভেম্বর থেকে আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর তিনজন সিনিয়র অফিসারের বিরুদ্ধে এক মামলায় ডুবে ছিল। এই অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ খান, কর্নেল প্রেম সেহগাল এবং কর্নেল গুরবখ ধিলন। ব্রিটিশ রানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার দায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। এমন ধরনের মামলার পোশাকি নাম 'রেড ফোর্ট ট্রায়াল'।

এর প্রায় তিন মাস পর, ১৯৪৬-এর ১৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বম্বেতে নৌবাহিনীর ১১টি ইউনিটের ২০ হাজার নাবিক বিদ্রোহে যোগ দেন। ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্রোহ দমন করতে আসা ব্রিটিশ সেনা এবং বিদ্রোহী ভারতীয় সেনারা একে অপরকে হুমকি দিতে থাকে। গোলাগুলিও চলে। ভারতীয় নৌবাহিনী বম্বে বন্দরের আশপাশে ২২টি জাহাজ দখল করে। ব্রিটিশরা ভয় দেখানোর জন্য পোতাশ্রয়ের উপর খুব কম উচ্চতায় যুদ্ধবিমান ওড়াতে শুরু করে। জবাবে, বিদ্রোহী মেরিনরা বম্বের চারপাশে বন্দি যুদ্ধজাহাজের কামানগুলি গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া (Gateway of India) এবং হোটেল তাজের (Hotel Taj) দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তারা ব্রিটিশদের হুঁশিয়ারি দেয়, যদি ভারতীয় মেরিনদের কোনো ক্ষতি করা হয়, দুটি সৌধই তারা উড়িয়ে দেবে।

আরও পড়ুন
দেশের জন্য লড়েও ছাড়তে হয়েছিল ভিটে, দিনাজপুরের ‘অবজ্ঞাত’ স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প

এইচএমআইএস তালওয়ার তখন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি। তখনকার দিনে কমিউনিকেশন ট্রেনিং হত। এখন একে বলা হয় নেভাল ট্রান্সপোর্ট ডিপো, যেখানে পুরনো জাহাজ মেরামত করা হয়। এটি দক্ষিণ মুম্বইয়ের কুপারেজ এলাকায় অবস্থিত। যাই হোক, নৌবাহিনীর ইতিহাসের উপর কমান্ডার শ্রীকান্ত বি কেসনুরের লেখা বেশ কয়েকটি বইয়ের সূত্র অনুযায়ী, এইচএমআইএস তালওয়ারেরও একটি রেডিয়ো স্টেশন ছিল। বিদ্রোহীরা এই রেডিয়ো স্টেশনের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিল, তাঁরা ধর্মঘট শুরু করছেন। এইভাবে তাঁদের এই বিদ্রোহ-বার্তা দেশের সমস্ত নৌ-শিবিরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ২০ হাজার জন, ৭৮টি যুদ্ধজাহাজ, ২৩টি নেভাল স্টেশন বিদ্রোহে যোগ দেয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি, করাচি বন্দরের সমস্ত নৌ অফিসে বিদ্রোহ শুরু হয়। এইচএমআইএস হিন্দুস্তানের নাবিকরা করাচি বন্দরের কাছে ব্রিটিশ অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে। ঘটনার প্রভাব এতটাই পড়ে যে, ১৯৪৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, কলকাতায় যুদ্ধজাহাজ এইচএমআইএস হুগলির নাবিকরা তাঁদের অফিসারদের আদেশ মানতে অস্বীকার করে।

আরও পড়ুন
গান্ধীজির আদর্শে আজীবন লড়াই, পদ্মশ্রী পেলেন দমনের বৃদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামী

দক্ষিণ বম্বের রাস্তায় 'ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো' স্লোগান ওঠে। ভারতীয় নৌসেনারা আজাদ ময়দানে মিটিং করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করে। সেদিন প্রতিটি রাস্তাই ছিল দক্ষিণ বম্বেমুখী। বম্বের এই এলাকার রাস্তায় দু-লক্ষের বেশি মানুষ সেদিন। বিদ্রোহ দমন করতে ব্রিটিশরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। ইংরেজ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বিদ্রোহ দমন করার জন্য কোলাবা এবং দক্ষিণ বম্বেতে ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৪০০ জনকে গুলি করে হত্যা করে। আহত হন দেড় শতাধিক মানুষ। নৌবাহিনীর এই বিদ্রোহ বম্বের কারখানার শ্রমিকদের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল। সে-কারণে নিহতদের বেশিরভাগই বোম্বাইয়ের।

আরও পড়ুন
একুশ শতকের ‘জাতক’ এই রাষ্ট্রগুলি, স্বাধীনতার অপেক্ষায় এখনও বহু দেশ

৪৬-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও ২ ফেব্রুয়ারি থেকেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হতে শুরু করে। বিদ্রোহের নেতৃত্বে জড়িত বি সি দত্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ''আমরা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে কাজ করা সেনাদের মুক্তি দাবি করেছিলাম। কারণ তাঁদের লক্ষ্য ছিল 'বিপ্লবী পদক্ষেপ' নেওয়া। তাঁরা তো আমাদের মতো দেশপ্রেমিকই ছিলেন। আমরা ২ ফেব্রুয়ারির সকালে এইচএমআইএস তালওয়ারের দিকে যাওয়ার কাঠের সিঁড়িতে 'ভারত ছাড়ো' এবং 'জয় হিন্দ'-এর মতো স্লোগানসহ পোস্টার সাঁটিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে, আমরা ধরা পড়ি। ৮ ফেব্রুয়ারি কোর্ট মার্শাল করি।''

বিচার চলাকালীন কমান্ডিং অফিসার ফ্রেডেরিক কিং তাঁদের সহকর্মী মেরিনদের উদ্দেশ্যে 'ব্ল্যাক বাস্টার্ড', 'সন অফ বিচ'-এর মতো জাতিবিদ্বেষমূলক গালাগালি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এর পরে এম এস খান এবং মদন সিংসহ ভারতীয় নৌসেনাদের অনশনে যেতে রাজি করান বি সি দত্ত। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে, ১৫০০ মেরিন স্লোগান দেন 'খাবার নেই! কাজ নেই!' একদিকে এমন আকাশভেদী স্লোগান, অন্যদিকে বম্বে এয়ার ফোর্সের পাইলট এবং বিমানবন্দরের কর্মীরাও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। পাইলটরাও এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলেন।

বিদ্রোহের অংশীদার নৌ কর্মকর্তা বি বি মুতাপ্পা বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমাদের অনেক নাবিক গোপনে বম্বের বিভিন্ন এলাকায় জওহরলাল নেহরু ও অন্যান্য নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য যেতাম। আমার ওপর মহাত্মা গান্ধির বড় প্রভাব ছিল। এই বিদ্রোহের সময়, ১৮ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে, গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া এবং তাজমহল হোটেলের কাছে নৌবাহিনীর উপকূলীয় শাখায় নিযুক্ত নাবিকরা ব্রিটিশ অফিসারদের কক্ষ এবং টয়লেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। বহু জাহাজেই একই ঘটনা ঘটে।'

ব্রিটিশরা ভয় পেয়েছিল, নৌবাহিনী তাজমহল প্যালেস হোটেল আক্রমণ করতে পারে। বাবুর্চি, ঝাড়ুদার, খাবার পরিবেশকদের সতর্ক করা হয়। এমনকী সামরিক ব্যান্ডের সদস্যদের অস্ত্র ছিনতাই করা হয়েছিল সে-কারণেই। ২২ ফেব্রুয়ারি নাগাদ বম্বের উপকূলীয় শাখা মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির সেনারা ঘিরে ফেলে। এ সময় বিদ্রোহী নাবিক ও তাদের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি চলে। বিদ্রোহী বি সি দত্ত এবং এম এস খানের সঙ্গী মদন সিংয়ের মতে, 'কংগ্রেস নেতাদের, বিশেষ করে সর্দার প্যাটেলের অনুরোধের পর আমরা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কোনো হয়রানি হবে না বলে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়। আমরা আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলাম যে, বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে মাথা নোয়াবে না; আত্মসমর্পন করলে জাতীয় নেতাদের কাছে করবে। এর পরেই ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে।' সর্দার প্যাটেল না থামালে এই দুটি ভবনই হয়তো কামান দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হত। এই বিদ্রোহের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি ভারত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে নির্ধারিত তারিখ ২০ জুন ১৯৪৮ সালের ১০ মাস আগে।

তথ্যসূত্রঃ
১. How Gandhi, Patel and Nehru colluded with Brits to suppress Naval Mutiny of 1946, dailyo.in
২. Royal Indian Navy mutiny - Wikipedia
৩. Patel Na Manaate to Gateway of India Ud Jaata, Dainik Bhaskar

Powered by Froala Editor

Latest News See More