ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজির ভূমিকা অনস্বীকার্য। যদিও গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানেই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তিনি। শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন গণ-আন্দোলন। তবে গান্ধীজির ভূমিকা এখানেই সীমিত নয়। আইনজীবী কিংবা রাজনৈতিক প্রচারক হিসাবে তো বটেই, তাছাড়াও ফুটবলকে হাতিয়ার করেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে (South Africa) একসূত্রে বাঁধতে চেষ্টা করেছিলেন গান্ধীজি (Gandhiji)।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা অবাক হওয়ার মতোই। তবে গান্ধীজির হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে-দেশের প্রথম ফুটবল ক্লাব। ঝাপসা হয়ে যাওয়া ইতিহাসের এই অধ্যায় জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে প্রায় ১২০ বছর।
ইংল্যান্ডে আইন নিয়ে পড়াশোনা করার সময় থেকেই ফুটবলের অনুরাগী ছিলেন গান্ধীজি। দলগত খেলা, বিশেষত ফুটবল যে মানুষকে একত্রিত করার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, তা ব্রিটেনেই প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি।
ব্রিটেনে পড়াশোনা শেষ করে ১৮৯১ সালেই দক্ষিণ আফ্রিকায় আইনের অনুশীলন শুরু করেন গান্ধীজি। এর ২ বছর পর এক গুজরাতি ব্যবসায়ীর মামলা লড়তে গিয়েই, তাঁর নজরে আসে প্রবাসী ভারতীয়রা ক্রমাগত শিকার হচ্ছে বর্ণবিদ্বেষের। বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন গান্ধীজি নিজেও। বুঝেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে একতা এবং ঐক্যের অভাবেই শ্বেতাঙ্গদের জুলুমের শিকার হতে হচ্ছে ভারতীয়দের।
বর্ণবাদের ইতি টানতে ১৮৯৪ শাল থেকেই আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন গান্ধীজি। সে-বছর তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশ পায় ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ নামের একটি পত্রিকা। ধারাবাহিকভাবে যা প্রচার করত শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী মানসিকতা এবং নিপীড়নের। এর ঠিক দু’বছর পর প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গবদ্ধ করতে আফ্রিকার মাটিতে আস্ত একটি ফুটবল সংগঠন গড়ে তোলেন গান্ধীজি। ‘ট্রান্সভাল ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’-খ্যাত এই ফুটবল সংগঠন পরিচালিত হত অ-শ্বেতাঙ্গদের দিয়েই। প্রবাসী ভারতীয় ছাড়াও এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও স্থানীয় আফ্রিকানরাও।
এই ফুটবল ক্লাবের মধ্যে দিয়েই সত্যাগ্রহের অনুশীলন শুরু করেন গান্ধীজি। বিভিন্ন ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের মধ্যে দিয়ে অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা সে-সময় প্রচার করতেন মহাত্মা। বিতরণ করতেন লিফলেট। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে ফুটবল খেললে মিলত অর্থও। সেই অর্থই খরচ জোগাত কারাবন্দিদের মুক্ত করার কিংবা তাঁদের পরিবারের হাতে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার।
গান্ধীজি-প্রবর্তিত এই ফুটবলপ্রেম পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকাতে। তার একটা কারণ হল, ফুটবল দরিদ্রদের খেলা। সরঞ্জামের খরচ নেই সেখানে। সেইসঙ্গে ক্রিকেটের মতো একটা গোটা দিন ব্যয় করতে হয় না ফুটবল খেলতে গেলে। কাজেই মেহনতি মানুষদের বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ হয়ে ওঠে এই দলগত খেলা। ডারবান, প্রিটোরিয়া এবং জোহানেসবার্গ— এই তিনটি শহরেই আলাদা আলাদা করে তিনটি ফুটবল ক্লাব গড়ে ওঠে পরবর্তীতে। তিনটির সঙ্গেই জড়িত ছিলেন গান্ধীজি। তিনটি ক্লাবই পরিচিত ছিল ‘প্যাসিভ রেজিস্টারস সকার ক্লাব’ নামে। তাছাড়াও ১৯০৩ সালে গান্ধীজির উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয় ‘দক্ষিণ আফ্রিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ হিন্দু ফুটবল’।
অবশ্য গান্ধীজি নিজে ফুটবল খেলতেন বা ফুটবলের প্রশিক্ষণ দিতেন— এমন প্রমাণ নেই কোনো। বরং, ফুটবল ছিল তাঁর কাছে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার-মাত্র। ফুটবলকে সামনে রেখেই সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে জাগরিত করতে চেষ্টা করেছিলেন বাপু।
২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ আয়োজনের সময়, গান্ধীজির অবদান সংক্রান্ত একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল সে-দেশের সরকার। পাশাপাশি ফিনিক্সে গান্ধীজি ও তাঁর সহকর্মীদের প্রতিষ্ঠিত ফুটবল গ্রাউন্ড আজও বিবেচিত হয় ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে। সবমিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফুটবলের প্রচলন এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তার পিছনে গান্ধীজির অবদান অনস্বীকার্য।
১৯১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে স্থানান্তরিত হন গান্ধীজি। এ-দেশে এসে শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। বৃহত্তর পরিসরে অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। তবে ফুটবলের সঙ্গে তখনও ক্ষীণ সম্পর্ক ছিল গান্ধীজির। প্রথমত এ-দেশে ফেরার পরও দক্ষিণ আফ্রিকার ক্লাবগুলিতে বন্ধ হতে দেননি তিনি। পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ফুটবল দলের খেলোয়াড় ক্রিস্টোফার কন্টিনজেন্টের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁর। ১৪ ম্যাচের একটি সিরিজ খেলতে ভারতেও এসেছিলেন ক্রিস্টোফার। সেবার অধিকাংশ সময়ই ক্রিস্টোফার ও তাঁর দলকে সঙ্গ দিয়েছিলেন গান্ধীজি। অথচ, ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর কেন ফুটবলপ্রীতি কমে গেছিল গান্ধীজির? কিংবা এ-দেশে ফুটবলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কেন এই খেলাকে তিনি বেছে নিলেন না স্বাধীনতা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারোর কাছেই…
Powered by Froala Editor