বাল্টিক সাগরের পারে গান্ধীজির মূর্তি, সঙ্গে কে?

ইউরোপের একটি ছোট্ট দেশ লিথুয়ানিয়া (Lithuania)। মাত্র ২৮ লাখের কাছাকাছি জনসংখ্যা। তার পশ্চিম প্রান্তের রুসনে (Rusne) শহরটির নাম ভারতবাসীর কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। কিন্তু বাল্টিক উপসাগরের তীরে গেলেই দেখা মিলবে এক চিরপরিচিত মূর্তির। খাটো ধুতি, গায়ে চাদর আর লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মহাত্মা গান্ধী (Mahatma Gandhi)। তার পাশেই রয়েছেন আরেক ব্যক্তি। পরনে স্যুট, প্যান্ট সামান্য গোটানো, দু-হাত পকেটে রেখে তাকিয়ে রয়েছেন আকাশের দিকে। মূর্তির তলায় লেখা ‘গান্ধী ও কালেনবাখ’ দেখে মুখস্থ করে নেওয়া যায় তাঁর নাম। কিন্তু প্রশ্ন হল, কে এই কালেনবাখ? ভারত থেকে বহুদূরে লিথুনিয়ায় গান্ধীজির সঙ্গে কী করছেন তিনি?

সারা বিশ্বের প্রায় সত্তরটি দেশে ছড়িয়ে আছে ‘বাপু’-র মূর্তি। শ-খানেক রাস্তা রয়েছে তাঁর নামে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরেও মূর্তিরূপে উপস্থিত তিনি। এই দেশ থেকেই শুরু হয়েছিল গান্ধীজির ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাস করার কিছুদিন পর তিনি মামলা লড়ার জন্য যান দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেটা ১৮৯৩ সাল। সে দেশে তখন ভারতীয়দের উপর বর্ণবৈষম্য ছিল রোজকার ঘটনা। ডারবানে নেমে গান্ধীজিকেও শিকার হতে হয়েছিল বৈষম্যের। পরবর্তীতে তিনি সেখানে গড়ে তোলেন শক্তিশালী আন্দোলন, বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন সত্যাগ্রহের আদর্শ। সেই সময়ে যে কজন বন্ধুকে তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রধানতম ছিলেন হেরমান কালেনবাখ (Hermann Kallerbach)। গান্ধী নিজে তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘আত্মার বন্ধু’ বলে।

১৮৭১ সালে লিথুয়ানিয়ার এক ইহুদি পরিবারে কালেনবাখের জন্ম। জার্মানি থেকে স্থাপত্যবিদ্যার পড়াশোনা শেষ করে ১৮৯৬ সালে চলে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। খ্যাতি আর সাফল্য দুইই অর্জন করেন, পারিবারিক সূত্রে মালিকানা পান বিরাট সম্পত্তির। ১৯০৪ সাল নাগাদ তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় গান্ধীজির। ধর্ম, সমাজ, জাতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় যেন নতুন পথ খুঁজে পান কালেনবাখ। ‘সত্যাগ্রহ’-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯০৮ সাল নাগাদ তিনি গান্ধীজির জন্য বানিয়ে দেন একটি বিশেষ বাড়ি। দুই বন্ধু ওখানেই থাকতেন দীর্ঘদিন। দুয়েক বছর পরে প্রায় হাজার একর জমি দান করে দেন গান্ধীজির নামে। দুর্দশাগ্রস্ত সত্যাগ্রহীর পরিবারদের সাহায্যে চালু হয় একটি ফার্ম, কালেনবাখ নিজেই তার নামকরণ করেন ‘টলস্টয় ফার্ম’। বিশাল সম্পত্তি ছেড়ে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো এখানেই থাকতে শুরু করেন তিনি। গান্ধীর আদর্শে শুরু করেন নিরামিষ খাদ্যগ্রহণ। ১৯১৫ সালে গান্ধীজি ভারতে ফিরে এলে, তাঁরও ইচ্ছে ছিল সঙ্গে আসার। কিন্তু ততদিনে শুরু হয়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাজনৈতিক কারণে দু’বছর বন্দি রাখা হয় কালেনবাখকে। যুদ্ধশেষে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গান্ধীজির কর্মকাণ্ডকেই এগিয়ে নিয়ে যান তিনি। অনেক পরে, তিনের দশকের শেষ দিকে অবশেষে ভারতে আসার স্বপ্নপূরণ হয় কালেনবাখের। ফের সাক্ষাৎ হয় দুই বন্ধুর।

আরও পড়ুন
পাঁচবার মনোনীত হওয়া সত্ত্বেও নোবেল পাননি মহাত্মা গান্ধী, কেন?

দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন গান্ধীজি অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন তাঁর উপর। আন্দোলনের খুঁটিনাটি তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যাও তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন গান্ধীজি। গত দশকে পরস্পরকে পাঠানো চিঠিপত্র উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় ভারতে। ইজরায়েলের হাইফা শহরেও মেলে কিছু ঐতিহাসিক দলিল। দুজনের সম্পর্কের গভীরতার নমুনা পাওয়া যায় সেখান থেকে। যদিও, সে নিয়ে জলঘোলাও কম হয়নি একটা সময়। 

আরও পড়ুন
মহাত্মা গান্ধী ও ‘জাতির জনক’ আখ্যা— একটি বিতর্ক

২০১৫ সালের ২ অক্টোবর, গান্ধীজয়ন্তীর দিন লিথুয়ানিয়ার রুসনেতে স্থাপিত হয় দুজনের মূর্তি। দেশবিদেশের পর্যটকরা ভিড় করেন তাঁর সামনে। সম্প্রতি লিথুয়ানিয়ার দূতাবাস থেকে সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে একটি অপূর্ব ছবি। রাতের আঁধারে বাল্টিক সাগরের সুমেরু প্রভার রাঙা আলোয় দেখা যাচ্ছে দুজনের ছায়ামূর্তি। যেন রকমারি আলোর ছটাকে পিছনে রেখে হেঁটে চলেছেন দুই বন্ধু। ভারত থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে ‘আত্মার বন্ধু’র সঙ্গে গল্পে মেতে রয়েছেন গান্ধীজি।

Powered by Froala Editor