প্রহর চারবছরে পা দিল আজ। চারপাশে তাকিয়ে দেখছি, খুব একটা হেলাফেলায় গেল না এতটা সময়। কত বন্ধুত্ব, যৌথতা, কাজের মতো কাজ ও অঢেল অকাজ, কত স্মৃতি... জন্মলগ্ন থেকেই অনিশ্চয়তা আমাদের ইয়ার-দোস্ত। এতদিনে বুঝেও গেছি, আমাদের এভাবেই মানায়। নির্বিঘ্ন ও সুনিশ্চিত জীবন আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে পারবে না সহজে। জন্মদিন বা জন্মলগ্ন নিয়ে আলাদা কোনো আদিখ্যেতা না-থাকলেও এই অনিশ্চিত টিকে থাকাটাকে তাই উদযাপন করতে সাধ হয়। এই বাজারে আরও একটা বছর গাড়ি চলল, এতজন একসঙ্গে থাকলেন। এই-বা কম কী!
কথায় বলে, সময় হাতে ধরে শেখায়। ফেলে আসা বছরটাও আমাদের যৌথতার অর্থ নতুন করে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে গায়ে থাবা মেরে। প্রথমে অরিত্র চলে গেল। অরিত্র সোম। প্রহরের প্রথম বৈঠক থেকেই অরিত্র আমাদের সঙ্গী। যাঁরা বিশ্বাস করেছিল, প্রহরকে ঘিরেও জীবিকা নির্বাহ করা যায়, অরিত্র তাঁদের অন্যতম। আমাদের সুহৃদ, আত্মীয়। এই ক্ষত শুকনোর আগেই অতর্কিতে চলে গেলেন অভীকদাও। অভীক চন্দ। যিনি না-থাকলে 'শিকাগো ডায়লগস' হয় না। 'কান্টো আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব' হয় না। যিনি না-থাকলে দেশ-বিদেশের বহু প্রথিতযশা মানুষ প্রহরকে চিনতেনই না। এহেন দুজন পরপর চলে গেলেন। আমরা বুঝলাম, যে-কজন আছি, তাদের একসঙ্গে জুড়ে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত অমোঘ। বাকি পৃথিবীর কথা জানি না, অন্তত আমাদের জন্য।
মাঝেমধ্যে ভাবি, প্রহরের থাকা আর না-থাকায় কী এসে যায়! প্রহর আদতে কী জড়ো করতে পারল ইতিহাসের খাতে? সমষ্টিগত স্মৃতির খাতে? একটা আদ্যোপান্ত বাঙালি পোর্টাল৷ একটা ভূতে পাওয়া স্বপ্ন ভর করায় হইহই করে যার জন্ম। যার পিছনে কোনো বড়ো-মেজো-ছোটো পুঁজির বিনিয়োগ নেই। নানা খামতি, সীমাবদ্ধতা নিয়েও যে আজও চলছে। হয়তো আরও কিছুদিন চলবে। হয়তো আরও অনেকদিন। কিন্তু, এই চলার সঞ্চয় কী? বলতে পারেন কেউ?
আমাদের জমানোর খাত অবশ্য ভর্তি। বলা ভালো, গোটাটাই সঞ্চয়। নানাকিছু জমাতে জমাতে আমাদের রেলগাড়ি চলছে। এই অনিশ্চয়তার মহাকাব্যে জমানোর মতো স্থায়ী শব্দ আর কিছু নেই। আমাদের চতুর্থ জন্মদিনে আমরা তাই নতজানু হয়েছি এই জমানো তথা সংগ্রহের কাছেই। বলা ভালো, সংগ্রাহকদের প্রতি। কেউ সংগ্রহ করেন স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত দলিল, কেউ-বা দেশীয় ধানের বীজ। টিকিট, গণপরিবহনের ইতিহাস, বুকমার্ক, পেঁচা, ক্যামেরা ও লেন্স কিংবা ফাউন্টেন পেন। এই বাংলার জীবিত এগারোজন সংগ্রাহকের গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে প্রহরের বিশেষ ক্রোড়পত্র 'একাদশ অশ্বারোহী'। প্রতিবারের মতো এবারেও এই সংখ্যাটির সম্পাদনা করেছেন শুভেন্দু দাশমুন্সী। বিশিষ্ট অধ্যাপক, লেখক ও সম্পাদক ছাড়াও তাঁর একটা অন্য পরিচয় আছে। আছে, শুধুমাত্র আমাদের কাছেই। শুভেন্দুদা, প্রহরের অন্যতম অভিভাবক।
লোভনীয় বিনিয়োগের নিরাপত্তা না থাকলেও অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা, প্রশ্রয় আর স্নেহ আমরা পেয়েছি এই চারবছরে। তা আমাদের ক্ষত নিরাময় করেছে। গ্লানি মুছে নিয়েছে সযত্নে। আমাদের শিখিয়েছে, অন্তত এই প্রাপ্তির লোভেই আরও কিছুটা পথ হেঁটে নেওয়া যায়। ভালোবাসার ঋণ বাড়লে পথহাঁটাও সহজে ফুরোবে না। এত বিচ্ছেদ, এত নেতি, এই ফুরিয়ে যাওয়ার মধ্যেও এইটুকুই হয়তো শাশ্বত...
'বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের
ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো;
তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা;
একটি পাখির গান কী রকম ভালো।'
#Prohor #NewsPortal