যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের অভ্যেস...

খবরের কী আশ্চর্য সমাপতন। রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ রাতারাতি খবরের শিরোনামে চলে এলেন। কাগজের শেষপাতায় খবর, ষোলো বছরের প্রজ্ঞানন্দ দাবার বোর্ডে হারিয়ে দিলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু ম্যাগনাস কার্লসেনকে। ফ্রন্ট পেজে খবর, ইউক্রেন আক্রমণ করল রাশিয়া। একটি সুবিশাল সাদাকালো বোর্ড, অশ্ব-গজ-নৌকা-অক্ষহীন সেনার রণডঙ্কা বাজছে ঘনঘন। খবরের কাগজ পাতা উলটে চলে যাচ্ছে। শেষ থেকে প্রথম, কিংবা প্রথম থেকে শেষ। যদিও প্রজ্ঞানন্দ রমেশবাবু ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হয়েছেন দশ বছর বয়সে, ২০১৬ সালে, খুব ভুল না করলেই তিনিই এ দেশের তরুণতম গ্র্যামন্ডমাস্টার— কিন্তু ম্যাগনাস কার্লসেন? আমরা যাঁরা দাবার অল্পস্বল্প খবর রাখি, কার্লসেনের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা নিয়ে আমরা সংশয়াতীত। কিংবদন্তি গ্যারি কাসপারভ ছাড়া এত দীর্ঘ সময় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের খেতাব কে-ই বা ধরে রাখতে পেরেছেন? নরওয়ের এই দাবাড়ুর আন্তর্জাতিক দাবার মঞ্চে উত্থানপর্বটির সাক্ষী আমরা। এর পিছনে অবশ্য আমাদের জাতীয়তাবাদী ব্যথা ও রয়েছে পুরোদস্তুর। ২০১০ সালে কার্লসেন যখন ওয়ার্ল্ড র্যা ঙ্কিং-এ ১ নম্বরে উঠে আসছেন তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি বছর। সাদাকালো বোর্ডে রাজাধিরাজের নাম তখন বিশ্বনাথন আনন্দ। ২০১৪ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ সেই মঞ্চ, যেখানে কার্লসেন আনন্দকে হারিয়ে প্রথমবারের জন্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেন। তারপরের বছরও ফের আনন্দকে হারতে হল। আমরা মিডিয়ার নানা খবরে গুজব শুনলাম কার্লসেন হিপনোটাইজ করেন। সে সময়ে একটু বইপত্র ঘেঁটে পড়েছিলাম বিষয়টা নিয়ে। আটাত্তরে দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ মঞ্চে অ্যান্টলি করপভ আর ভিক্টর কর্চনোই-এর খেলায় এমন অভিযোগ প্রথম উঠেছিল এবং শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। তারপর দাবায় সেল্ফ হিপনোসিস, অপোজিশন হিপনোসিস নিয়ে অজস্র আলোচনা হয়েছে। নদী দিয়ে বয়েছে অনেক জল। কিন্তু কার্লসেন (Magnus Carlsen) অবলীলায় পরপর শুধু জিতেছেন। তাঁর ওপেনিং গেমসের যে বৈচিত্র্যদ তা কোনোদিনই তাঁর সামনে সাবলীল হতে দেয়নি প্রতিপক্ষকে, আর এন্ডগেমে চেনা আগ্রাসনে তিনি আধুনিক দাবার ববি ফিশার! 

সেই ম্যাগনাস কার্লসেন হারলেন। অনলাইন কম্পিটিশনে তাঁকে হারিয়ে দিল প্রজ্ঞা। ব্ল্যাক পিস বা কালো ঘুঁটিতে। উচ্ছ্বসিত দেশের তাবড় ক্রীড়াবিদরা। প্রজ্ঞানন্দ রমেশবাবু জানেন, এ অধ্যাবসায় ধরে রাখলে তিনি একদিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সে দিন দূর নেই। কার্লসেনের নরওয়ে মাস্টার্স জিতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পা রাখাও এমন বয়সেই। তবু, ক্ষমতার বিচারে যে প্রজ্ঞা বামুন হয়ে চাঁদ ছুঁয়েছে তা উদযাপনের, আমরা ক্ষমতাহীনের দখলকে উপহার দিই উচ্ছ্বাস, প্রজ্ঞা অচিরেই সেই ট্র্যােডিশনে আমাদের বোরে। ক্ষমতা ও দখল শব্দদুটিকে দাবার বোর্ড চিরকাল কত ডাইমেনশনে ধরে রেখেছে চালের ওজনে। একদা হাবিবুল বাশারের বাংলাদেশ রিকি পন্টিং-এর অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিতে এশিয়ার ক্রিকেটমোদীরা প্রবল আনন্দ পেয়েছিলেন। এ এক সময়ের নির্মাণ। রাশিয়ার প্রবল আক্রমণের সামনে ইউক্রেনের প্রতিরোধকে আমরা বাহবা দিচ্ছি। কিন্তু দখলের ইতিহাসের সাদাকালো ব্ল্যাকবোর্ডে আমরাও তো সামান্য সেনাই। ২০২১ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে একটি বড়োসড়ো আর্টিকল লেখেন। ইউক্রেনের থেকে রাশিয়া কী চায় তা বেশ বিষদে লেখা হয়েছিল সেই আর্টিকলে। লেখায় ইউক্রেন এবং রাশিয়াকে ‘এক দেশ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন পুতিন; এবং অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR)-এর ভাগ হওয়াকে ঐতিহাসিক রাশিয়ার বিচ্ছিন্ন হওয়া বলে ঘোষণা করেন। ইউক্রেনের নেতারা সে দেশে রাশিয়া-বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে তার তীব্র নিন্দা করেন পুতিন। এদিকে রাশিয়ার অসন্তোষের আরও একটি বড়ো কারণ ন্যাটোর বাড়বাড়ন্ত। ইউক্রেন ন্যাটোর অংশ হোক তা কোনওভাবেই চান না পুতিন।  ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার বিবাদ সর্বজনবিদিত। USSR-এর সঙ্গে ৪৫ বছর ধরে ঠান্ডাযুদ্ধের ইতিহাস ভোলেনি কেউ। তবে ওই যে দেশ শব্দটির বিশালতা কোনওদিনই কাঁটাতার দিয়ে বাঁধা যায়নি। সোভিয়েত ভাঙনের পর পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলির জন্ম হল,তাদের বহুজনতা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে এখনও রাশিয়ান। ভাষা এর একটি বড়ো কারণ। তবে পশ্চিমী প্রভাব সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। পুতিন এই আক্রমণের পিছনে যে আরও একটি কারণ বহুকাল ধরেই বলে আসছেন তা হল নাতসিমুক্ত ইউক্রেন গড়া, নাতসিদের ইহুদিদের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা নিয়ে আগেও সরব হয়েছেন পুতিন। কিন্তু একথা তিনি নিজেও জানেন সাম্প্রতিক অতীতে ইউক্রেনে কোনও গণহত্যাই হয়নি। আর ইহুদিদের প্রতি দুর্বলতাই যদি কারণ হয়, তবে আমাদের মাথায় রাখা আশু প্রয়োজন যে প্রেসিডেন্ট ভেলাদিমর জেলেনস্কি নিজেই একজন ইহুদি। ইউক্রেনের আগের প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ সরে যাওয়ার পর থেকেই এ সমস্যার শুরু। ইয়ানুকোভিচ-পুতিন সম্পর্ক টিকে ছিল স্রেফ রাশিয়ান আনুগত্যের বিষয়টিকে নতমস্তকে মেনে নেওয়ার কারণে।

প্রাতিষ্ঠানিকতা যে দখলের আদিম প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়, পুতিন সে প্রশ্রয়ে উন্মাদপ্রায়। দখল, দখল ও দখলের এই নারকীয় খেলায় বানের জলে ভেসে যায় মানুষ। বোমার শব্দে কেঁপে ওঠে সদ্যোজাত। প্রজ্ঞানন্দ দাবার বোর্ডের পাশে বসে এসব দেখতে পাবেন না কিছু। খেলা কবে নেমে আসে মাটির পৃথিবীতে। প্রজ্ঞানন্দ যে মুহূর্তে কার্লসেনকে হারিয়ে দেন সে মুহূর্ত আসলে দখলের, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার। খেলার বোর্ডে যা জয়, রণক্ষেত্রে তা-ই নিশান। 

"যুদ্ধের পুরোনো রোদ এসে
গমের দানায় আর তুলোর বীজের সঙ্গে মেশে।
যুদ্ধ সেই কবে হল শেষ।
তবু আমরা যার যার বাঙ্কারে লুকিয়ে আছি
যুদ্ধ নয়। যুদ্ধের অভ্যেসে।"

আরও পড়ুন
বিভেদের মাংসের টুকরো

প্রাণ সৃষ্টির আদিলগ্নে, এককোষী প্রাণী থেকে আম্ফিবিয়ান, সরীসৃপ হয়ে হিমযুগ পেরিয়ে যে যুদ্ধ জিতে আজ মনুষ্যজাতি গড়েছে সভ্যতা, মানচিত্রে কালো কালো দাগ মুছে গড়ে নিয়েছে দেশ, কিংবা অন্তরে দ্বেষ— তা থেমে গেছে বহুকাল। এখন এই ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ আসলে যুদ্ধের অভ্যেস। অন্তরে থেকে যাওয়া দ্বেষবৃক্ষের শাখা মেলা। 

আরও পড়ুন
ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা

একটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা আমাদের দাবার বোর্ড থেকে যুদ্ধক্ষেত্র অবধি টেনে নিয়ে যায় হাত ধরে। মাঝে পেরিয়ে যায় খুন, ধর্ষণ, লুঠপাটের ধারাবাহিক ইতিহাস। প্রজ্ঞানন্দ কইংবা ম্যাগনাস কার্লসেন বিধাতা নন, ভাগ্যিস, তাঁদের ক্ষমতার তারতম্যে জয়-পরাজয়কে আমরা উচ্ছ্বাস-মনখারাপের পানসি ভাসানোতেই বেঁধে রাখি। অথচ এই ভারতের মাটিতে (কেউ কেউ বলেন পারস্যে) জন্ম নেওয়া একটি খেলা আয়নার মত ধরে রাখে বিবর্তনকথা। 

আরও পড়ুন
পুরস্কার, বঞ্চনা ও ‘তুলসীদাসী’ নিয়তি

ভিশি-কার্লসেন-ক্যাসপারভদের অলক্ষ্যেই দাবার বোর্ড থেকে একটি সামান্য বোড়ে ক্রমে এগিয়ে চলেছে প্রতিপক্ষের সীমানায়। কখন যে সে সীমান্ত ছোঁবে, আর নিয়মের জাদুকাঠি ছুঁয়ে হয়ে উঠবে মন্ত্রী, ক্ষমতা আর দখলের ইতিহাসের পাশে রাখা চেসবোর্ডে চেয়ে থেকেও বুঝবে না আমজনতা৷ শুধু পালটে যাবে তাদের জয়ধ্বনির নাম। যুদ্ধ শুরু হবে ফের। যুদ্ধ নয়। যুদ্ধের অভ্যেস...

Powered by Froala Editor