ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা

আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস জিতে সেনেগাল ফুটবলাররা পা রাখলেন রাজধানী ডাকারে। খবরের কাগজে চোখ আটকে গেল একটি ছবিতে। লিভারপুলের তারকা সাদিও মানে, কোচ আলিও সিসে, প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সলরা ট্রফি হাতে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে। দূর দূরান্ত অবধি শুধু কালো কালো মাথা। মানুষের। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বললে বিষয়টা উপাদেয় হয়ে ওঠে এলিট সমাজে। ল্যাংস্টেন হিউজের কবিতা থেকে সুমন লিখেছিলেন সেই লাইন— 'রাত্রি নামবে যখন, আহা আমার মতো কালো...'।

নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে ছবিটা নিয়ে চলে গেল বহুদূরে। বিশাল উঁচু হোর্ডিং-এর কাঠামোয় ঝুলছে মানুষ, রাস্তায় মানুষ, বাড়ির ছাদ থেকে গাছের ডালে ঝুলে ঝুলে মানুষ দেখছে তাদের তারকাদের। তাদের সুপারহিরোদের। কদাচিৎ এমন দিন আসে। এমন উথলে ওঠা আলো এসে পড়ে সেনেগালের রাজপথে। সেনেগাল। আফ্রিকার অরণ্যে ঘেরা সবুজ দেশ। ফরাসি ঔপনিবেশিক শোষণে ক্ষতবিক্ষত দেশ। যদিও আফ্রিকার যে-কোনো দেশেই দারিদ্র্যের বড়ো কারণ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা। হিউম্যান রাইটস জানাচ্ছে, দেশের পঞ্চাশ হাজার শিশু এখনও রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি করে সেনেগালে। তেতাল্লিশ শতাংশ জনতাই নিরক্ষর। আভ্যন্তরীণ কোন্দলও পাশ্চাত্য সভ্যতা থেকে আরও দূরে ঠেলেছে সেনেগালকে। আফ্রিকার একেবারে নিজস্ব গন্ধ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে। দারিদ্র্যেনর কাঁথা যেখানে ঢেকে রাখে আবশ্যকীয় বেঁচে থাকা। 

কিন্তু একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট জিতে এমন বাঁধনহারা উল্লাস তো আরোপিত না, স্বতঃস্ফূর্ত, গতকাল এই ঘটনা নিয়ে এক অগ্রজের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম৷ তাঁর প্রশ্ন ছিল, এত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই, তারপরও এ প্রাণশক্তি,  ফুটবল খেলাটার প্রতি এই আগলহীন আবেগের উৎস কী? আমরা তো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় মনের গভীরে থাকা ইচ্ছেদের রাখতে পারি না। সেখানে খাদ্য, বস্ত্র আর বাসস্থানের পরেও থাকে কিছু অযাচিত শূন্যতা। ফিরে যাচ্ছিলাম 'পথের পাঁচালী'র রেলগাড়ি দেখার দৃশ্যে। শহরের পুজো থেকে বহুদূরে ফুটে ওঠে কাশফুল। দুই গ্রাম্য বালক-বালিকার ভেতর জেগে ওঠে পুজোর রেশ। তারা ছুটে চলে কাশবনের ভেতর। ছোটো ছোটো দুঃখকথা ঘেরা জীবন উচ্ছ্বল হয়ে পড়ে অনুভূতির চোরাটানে। অনেক থাকার মাঝে কিছু পাওয়া, আর কিছুই না থাকার মাঝে একটিমাত্র পাওয়ার তফাৎ অনেক। শহুরে মানুষের মনে এ দৃশ্যপটে লেগে থাকে কিছু মায়া। সেনেগালের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছোয়নি। কিন্তু ফুটবল খেলাটা পৌঁছেছে। চলতি শতাব্দীর গোড়ায় সেনেগালের প্রথম তারকা ফুটবলার হিসেবে উঠে এসেছিলেন হেনরি কামারা। সেনেগালের সর্বোচ্চ গোলস্কোরারও তিনিই। ফরাসি লিগে চুটিয়ে খেলে প্রথম কামারা একটা পথ দেখালেন। সেনেগালের যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, অপুষ্টি এবং শিশু মৃত্যুর ছায়া পেরিয়ে পরের কুড়ি বছরে কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু তারকা ফুটবলার উঠে এলেন। 

আফ্রিকায় ইজিপ্ট, নাইজিরিয়া, ঘানার সাথে তুল্যমূল্য লড়াই করার মত একটা দলও তৈরি হল সেনেগালের। সাদিও মানের নাম এখন বিশ্বফুটবলের মহাতারকাদের সাথে উল্লেখ করা হয়। এ-বছর আফকনজয়ী সেনেগালের অধিনায়ক। লিভারপুলের সাদিও মানেকে নিয়ে লেখা যেতে পারে এক দীর্ঘ উপন্যাস। তাঁর ফুটবলজীবন নিয়ে নয়, বাদামবনের পাশে ছোটো ভাঙাচোরা ঘর থেকে, ছেঁড়া বুট কোনোমতে বেঁধে ফুটবলার হতে চাওয়ার লড়াই নিয়ে লেখা হতে পারে কোনো কবিতাও। সাদিও-র সঙ্গেই চলে আসবে এডুয়ার্ডো মেন্ডির নাম। সেনেগালের গোলকিপার। যাঁকে আগের মরশুমে প্রিমিয়ার লিগে নিজেদের দলে এনেছিল চেলসি ফুটবল ক্লাব। আর বাকিটা তো ইতিহাস। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় থেকে চেলসির দুরন্ত দল হয়ে ওঠার পিছনে থেকেছে মেন্ডির বিশ্বস্ত হাত। কোচ আলৌ সিসের গল্পখানা তো আবার বলিউডি ফিল্মের মতো। কবীর খান ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবিতে যা করে দেখিয়েছিলেন, সিসের জীবন যেন রিল থেকে রিয়েলে এসে তারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটয়ে গেল।২০০২ সালে মালিতে, আফকন ফাইনালে পেনাল্টি মিস করে সেনেগাল জনতার কাছে ভিলেন হয়ে ওঠা সিসের শাপমুক্তি হল এবার। কোচ হিসেবে সেনেগালকে দিলেন তাঁদের প্রথম আফ্রিকা কাপ অফ নেশান্স ট্রফি। 

তবে, এখানে গল্পটা শেষ নয়। কেবলই দারিদ্র্য ভেঙে তারকাদের উঠে এসে দেশকে জেতানোর গল্পে এ ছবি সীমাবদ্ধ নয়। এ ছবি আমাদের আরও বড়ো একটি সামাজিক চরিত্রের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেনেগালের এই সব তারকা ফুটবলাররা ইউরোপে সুনামের সঙ্গে ফুটবল খেললেও, তাঁদের উত্থানের শিকড়টিকে তাঁরা লালন করেছেন যত্নে। সাদিও মানে, যাঁর বর্তমানে সাপ্তাহিক রোজগারের অঙ্কই হয়তো আমাদের চোখ কপালে তুলে দেবে, সেই সাপেক্ষে কিন্তু ইউরোপীয় উদ্দাম জীবন বেছে নেননি। তাঁর বিরাট পারিশ্রমিকের একটা বড়ো অংশ তিনি দান করছেন সেনেগালে তাঁর ছেলেবেলার গ্রামে স্কুল নির্মাণে। এ কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, একজন লিভারপুলের তারকা ফুটবলারের হাতে যে মোবাইল ফোনটি থাকে তার স্ক্রিনটির অবস্থা জীর্ণ। লিভারপুলের প্র্যানকটিসে যাবার সময় সাংবাদিকদের নজরে আসে ফোনটি। সম্মেলনে যখন তাঁকে এ প্রশ্ন করা হয় যে কেন তিনি কোটি কোটি টাকা উপার্জনের পরেও নতুন ফোন কিনছেন না তখন সাদিও-র জবাবটি ছিল চমৎকার। 

‘আমি দারিদ্র্যে ভেঙে উঠে এসেছি। ফেরারি গাড়ি, হিরে, পোশাকআশাকের বিলাসিতার চেয়ে আমার কাছে জরুরি আমার দেশের দারিদ্র্যযমোচন, আমার দেশের বাকি জনতাকে শিক্ষিত করা। জীবন আমাকে যা দিয়েছে, আমি চাই আমার দেশের মানুষও তার কিছু অংশ পাক।’ 

এই শেষ কথাটি ভেঙে চুরমার করে দেয় পুঁজিবাদী পৃথিবীর দম্ভ। ছেলেবেলা সামান্য রুটির জন্য কয়েক মেইল পায়ে হাঁটা কৃষ্ণাঙ্গ এক সেনেগালিজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখান মাটির পৃথিবী।

এই জীবন দর্শন কিন্তু কেবল সাদিও মানে-র নয়। এডুয়ার্ডো মেন্ডি থেকে নাপোলির কোলিবালি, প্যারিস সেন্ট জার্মানের ইদ্রিস গিয়ে— সকলের সঙ্গেই থেকে গেছে সেনেগালের জনতার এক অদৃশ্য বন্ধন। যে আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে তাঁরা উঠে এসেছে সেই খণ্ড থেকেছে তাঁদের ভেতর। ফলে, আফকন জয়ের পর সেনেগালিজ জনতার উচ্ছ্বাসের এ ছবি আসলে ইউটোপিয়া মনে হলেও এই বিশ্বের বুকে একটি মডেলকে চিনিয়ে দেয় আমাদের। সচিন তেন্ডুলকর, লিওনেল মেসিরা কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ হলেও দেশের জনমানসের প্রতিটি অংশের সঙ্গে তাঁদের যোগ নিবিড় নয়, হতে পারে না। কারণ তাঁরা উঠেই আসেননি সেই কমিউনিটি থেকে। সাদিও মানে, ইদ্রিস গিয়ারা এসেছেন। দেশের জনতার মনের গহীনে তাঁরা এখনও রঙিন পৃথিবীর জাদুকর হয়ে ওঠেননি, আছেন তাঁদেরই প্রতিনিধি হয়ে। কলকাতার পড়তে এসে অপুর ভেতর যেমন থেকে যায় একফালি নিশ্চিন্দিপুর, খুলনার নৌকায় বসে তাঁর কলমে উঠে আসে গ্রামের কথা, অপর্ণার মৃত্যুর পর নিশ্চন্দিপুরের হিজলের বন, জোনাকিরা চিনে ফেলে তাঁদের অপুকে, সেভাবেই তো বুকের ভেতর জেগে ওঠে দেশ। সেনেগালের জনতার এ উচ্ছ্বাস আসলে হানাহানির পৃথিবীতে আমাদের কিছু মায়া আগলে আগলে রাখে। আমরা বুঝি, জনতা ও তার ভেতরে থাকা সূক্ষ্ম অনুভূতি সেই জনমানসের প্রতিনিধিদের আচরণের সঙ্গে মিশলেই এমন দেশের জন্ম হয়, জন্ম হয় এমন দৃশ্যেরও...

Powered by Froala Editor