বছরখানেক আগে শুভদা-র সঙ্গে আড্ডায় শুনেছিলাম গল্পটা। বাগবাজার এলাকা দিয়ে খুব ভোরে ফেরার পথে বাসে ওঁর সঙ্গে দেখা এক বৃদ্ধের। সত্তরোর্দ্ধ মানুষকে বৃদ্ধ বলাই দস্তুর। ভোরের বাসে তেমন ভিড় নেই। তবে এই বৃদ্ধকে দেখে চিনে ফেলেছিলেন শুভদা। সটান গিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন—
'আপনি বলরাম না? আমাদের তুলসীদাস বলরাম?'
কেঁদে ফেলেছিলেন ভদ্রলোক। এড়িয়ে যেতে চেয়েও যেতে না পারার ফলস্বরূপ তাঁকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল এক অনুসন্ধিৎসু তরুণের। প্রাথমিকভাবে না বললেও আর চেপে রাখতে পারলেন না নিজেকে। মহানগর সিনেমার শেষ সিনে মাধবী মুখোপাধ্যায় যেভাবে অনিল চ্যাটার্জিকে জাপটে ধরে বলেন— ‘এত বড়ো শহর৷ এত রকম চাকরি। দু'জনের কেউ কি একটা পাব না?'— সেভাবেই বোধ হয় শুভদা প্রশ্ন করেছিলেন অদৃষ্টকে৷ এত বড়ো শহর৷ এত জোড়া চোখ। কেউ কি চিনতে পারল না ? সাদামাটা একটা ফতুয়া, পাজামার এক অবয়ব। বাহুল্যের লেশমাত্র নেই। পকেটে খুচরো। জীবনের সিকি-আধুলিদের যে হয়ে ওঠা হল না দক্ষিণা...
দিনকয়েক আগে পদ্মশ্রী পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একটা হইহই পড়ে গেল বাংলায়। পুরস্কারের সঙ্গে স্বীকৃতির এক অদ্ভুত সম্পর্ক। সময় ও কীর্তির সূচকে সে পালটে পালটে যায় কেমন। কেউ কেউ দাবি তুললেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের যে গরিমা, তা রাষ্ট্রপ্রদত্ত, তা অস্বীকার মানে তো রাষ্ট্রের অপমান! শিশির ভাদুড়ী যখন ’৫৯ সালে পদ্ম পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন, তার পিছনে যুক্তিটি ছিল জোরালো। এ পুরস্কার নিলে বাংলার নাট্যসমাজের কাছে এই বার্তা যাবে যে সরকার নাট্যসংস্কৃতির প্রসারে অগ্রণী। অর্থাৎ, নাটকের যে মঞ্চ, যেখান থেকে সত্যের হলদে আলো ছিটকে আসে অভিনেতার মুখে, আভরণহীন সেই আলোর নিচে দাঁড়ানো শিশির ভাদুড়ীর কাছে পদ্মভূষণ নেহাত পুরস্কার নয়, এ আসলে স্বীকৃতির চেয়েও বেশি করে দেখনদারি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তাই। সত্তর সালে নিশিপদ্মে গান গেয়ে জাতীয় পুরস্কারের পঞ্চাশ বছর পর যখন তাঁকে দেওয়া হচ্ছে পদ্মশ্রী তখন তিনি সেই পুরস্কারের যে পরিধি, তার স্বীকৃতি প্রদর্শনের যে সর্বোচ্চ উচ্চতা, যতদূর বৃত্তের ভেতর মানুষের কৃতিত্বকে সে বেঁধে ফেলতে পারে সোনার শেকলে, গীতশ্রী তো কবেই অতিক্রম করে চলে গেছেন সে সীমানা। সচিন তেন্ডুলকর ভারতরত্ন পেলেন ২০১৪ সালে। সে সময়ে যদি তাঁকে দেওয়া হত পদ্মশ্রী? মারাঠি সমাজে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারত সহজেই অনুমেয়।
আরও পড়ুন
এ যদি আমার দেশ না হয়, তো...
তবে স্বীকৃতি-পুরস্কার-সম্মানের-সম্মানের ঘেরাটোপের বাইরে রয়েছে এক প্রত্যাখ্যানের পৃথিবী। এ প্রত্যাখ্যান কিন্তু কেবল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান নয়। নিজের ভেতরের যাবতীয় শক্তি দিয়ে অদৃষ্টকে প্রত্যাখ্যান এক নিজস্ব পৃথিবী গড়ে নেয়। সেখানে সে নিজে অবিরাম ঘুরে বেড়াতে পারে। স্বীকৃতির পরোয়া না করেই। সে গল্পেই ফিরি তবে। এ লেখার গোড়ায় যে মানুষটিকে দেখে ফেলেছিলেন শুভদা এক শুনশান মিনিবাসে, তাঁর নাম পদ্মশ্রীর জন্য সুপারিশ করা হয় ১৯৯০ সালে। হল পুলিশ ভেরিফিকেশনও। শেষ অবধি কোনো অজ্ঞাত কারণে যখন চূড়ান্ত তালিকা বেরোল, দেখা গেল তিনি নেই। এ ঘটনা যদিও নতুন নয় তাঁর জীবনে। সে সময়ে না কোনও মিডিয়া, না কোনও ক্ষমতাশীল প্রশাসক ন্যূনতম গলা তুললেন এ নিয়ে। নীরবে সব মেনে আরও অন্তর্মুখী হয়ে গেলেন তিনি। তুলসীদাস বলরাম, ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরোয়ার্ড, হ্যাঁ, অন্যতম শব্দটা বসানোর জন্য তাঁরই দুই প্রিয় বন্ধু পিকে ব্যানার্জি ও চুনী গোস্বামী-ই দায়ী। তাঁকে কী স্বীকৃতি দিল দেশের সরকার? পিকে-চুনী পদ্মশ্রী পেলেন। হালের বাইচুং-সুনীল ছেত্রীকেও পদ্ম স্বীকৃতি দিল সরকার। আমরা যেন ভুলেই গেলাম এক ছটফটে, চনমনে হায়দ্রাবাদী তরুণের কথা। ভারতের দুয়োরানি ফুটবল খেলাটার ওই যে চিকচিকে একফালি স্বর্ণযুগ, যা কিনা এখন ঘাঁটতে বসলে চোখের কোণে বহুযুগের ওপার থেকে আষাঢ় বা কাঁকড় কিছু একটা এসে পড়ে, সেখানে তো অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তুলসীদাস বলরাম। ছাপ্পান্ন সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে বুলগেরিয়া ম্যাচে উনিশ বছরের তুলসীদাস যখন প্রথম জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামছেন, রহিম সাহেব বুঝে যাচ্ছেন এ ছেলে আগামীর তারকা!
আরও পড়ুন
তারা খসার দিনরাত
চারবছর পরেই তো এ দেশের জল-মাটি-হাওয়ায়-হাওয়ায় মিলে মিশে গেছেন পিকে-চুনী-বলরাম ত্রয়ী। ক্রিকেটে নবাব পতৌদি সম্মোহনের চেয়েও জোরালো মাদকতা নিয়ে এলেন ভারতীয় ফুটবলের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। রোম অলিম্পিকে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে সেকেন্ড হাফে ভারত যে ফুটবল খেলল তা দেখে তাজ্জব বনে গেলেন ইউরোপীয় জনতা। স্ট্যানলি রাউজ তো ম্যাচের পর বলেই দিলেন রহিম সাবের ভারতই হল— 'দ্যা বেস্ট টিম ফ্রম এশিয়া', আর বলরাম? হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ৬৯ মিনিটে ভারতের একমাত্র গোলটি করে গেলেন অবলীলায়। পিকে ব্যানার্জির ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক গোলের আগেই কিন্তু সেবেচের দেশ হাঙ্গেরির দুর্ধর্ষ দলটার বিরুদ্ধে গোল করে গেছিলেন বলরাম। অদৃষ্টের ফেরে এ গোল তো বিস্মৃতপ্রায়। ষাটের অলিম্পিকের পরের তিনবছর বলরামের কেরিয়ারের স্বর্ণযুগ। মারডেকায় রুপো, বাষট্টির এশিয়াডে সোনা জয়ের পর ফরচুনাটা ফ্র্যাং কো তো বলেই ফেললেন— 'চুনী, বলরামের মতো প্রতিভা এ দেশে জন্মায় শতকে এক আধটাই..'
আরও পড়ুন
‘একবার বেঁচেছি দেবতা হয়ে’
ইস্টবেঙ্গলেরও যে তখন নয়নের মণি তিনিই। চুনীর মোহনবাগান আর বলরামের ইস্টবেঙ্গল, বাঙালির দ্বিমুখী আবেগের স্রোত বইছেন দুই বন্ধু। কিন্তু ঐ যে অদৃষ্ট! ঠিক যেভাবে পদ্মশ্রী পুরস্কার থেকে নাম বাদ হয়ে গেল আচমকা, তার চেয়েও আচমকা ঘটে গেল তাঁর অবসর। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি কলকাতা লীগ খেলার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। লাং ইনফেকশান। ডাক্তারের একটা কলমের আঁচড়ে ২৭ বছর বয়সে কেরিয়ার শেষ!
গতবছর আমফানের সময় দুঃস্থ মানুষদের সাহায্যার্থে আমরা একটি ক্রীড়াপত্রিকা করেছিলাম বন্ধুরা মিলে। সেখানে বলরামের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। আমার ভ্রাতৃপ্রতিম দীপ ওর শ্রীরামপুরের বাড়ি থেকে সাইকেল চেপে উত্তরপাড়া এসে তুলসীদাস বলরামের ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়িতে, একটা টেপরেকর্ডারে বন্দী করেছিল ওঁর ভাষ্য। দীর্ঘ সে সাক্ষাৎকারের অনুলিখনে দীপ এক চমৎকার শিরোনাম দিয়েছিল। আমার স্মৃতিতে এখনও তা স্পষ্ট।
' যারা শুধু দিয়ে গেল, পেল না কিছুই...'; এইটিই ছিল শিরোনাম। লাং ইনফেকশনের পর অকৃতদারই থেকে গেলেন৷ হায়দ্রাবাদ ফুটবল একাডেমির বাঙ্কার থেকে ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে থাকা তুলসীদাস সেই যে পাঁচের দশকে কলকাতা এলেন ভারতীয় দলের অধিনায়ক আজিজুদ্দিনের হাত ধরে, তারপর কবেই যেন এ ময়দানি ঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর মত থেকে গেলেন, তাতে ক্ষণিকের আলো পড়ে চকচকে হল বটে, তবে এ শহরের বাঁশুরিয়ার মতো তার দেশের কথা আর যেন মনে পড়ে না। থেকে গেলেন ভালোবাসার টানে। অথচ আজ, এই শহর তাঁকে চিনে উঠতে পারে না। পাবলিক বাসে কেঁদে ফেলেন স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার। সেই মুহূর্তে যেন খসে পড়ে যায় পুরস্কার-স্বীকৃতির রঙিন পৃথিবীর পলেস্তারা। খবরে পড়ছিলাম তুর্কির কিংবদন্তি ফুটবলার হাকান সুকুর, গালাতাসারের হয়ে চোদ্দটি খেতাব জেতা বিশ্বত্রাস স্ট্রাইকার সুকুর, মার্কিন মুলুকে উবের চালিয়ে দিন গুজরান করছেন। যদিও সুকুরের এই পরিণতির পিছনে একটি রাজনৈতিক সমস্যার বিষয় আছে। তবু, দিনশেষে ঐটুকু বাদ দিলে এ ও এক অসহায়তা আমাদের।
বলরাম, আর ফুটবল খেলাই দেখেন না। এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন মনে হয় আজ। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। মুখের ওপর বলেন, দৃষ্টি থাকলেও দেখতাম না। তাঁর ঘরের দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা—
"আমার মৃত্যুর পর আমার নশ্বর দেহ দাহ করবেন না, দেহটি দান করে দেবেন", দৃষ্টি চলে যায় জানলা দিয়ে দূরে। গঙ্গার তীর ঘেঁষে চব্বিশ পরগণার দিকে চলে যাচ্ছে স্টিমার, তুলসীদাস বলরাম ফুটবল থেকে দূরে আরও দূরে চলে যাচ্ছেন। স্বেচ্ছায়। দেওয়ালে টাঙানো মেলবোর্ন, রোম অলিম্পিকের দলের ছবিগুলো প্রাণপণে টেনেও আটকে রাখতে পারছে না তাঁকে। জীবনের শেষ ক'টা দিন সমস্ত আনুকূল্যের বিরুদ্ধে তাঁর ভেতরে জন্ম নিয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান নিয়ে যে হইচই, তা এক রকম পৃথিবী। সময় ও কৃতিত্বের সূচকে যা তর্কসাপেক্ষ। তিরিশ বছর আগে তুলসীদাস বলরামের পদ্মশ্রী বঞ্চনার পিছু পিছু এই যে পাবলিক বাস হয়ে একটা ছোট ফ্ল্যাটবাড়ি অবধি এসে দাঁড়ালাম আমরা, এই গল্প, যেখানে একজন কিংবদন্তি ফুটবলার প্রতিদিন একটু একটু করে অবহেলিত হতে হতে ফুটবল দেখাই ছেড়ে দিয়েছেন, সে গল্প গড়ে নিচ্ছে স্বতন্ত্র মহল। তাঁর দেহদানের ইচ্ছে মাননীয় সরকার পূরণ করবেন হয়তো, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দান করা শরীর চলে যাবে কোনো মেডিকেল পড়ুয়ার সামনে অ্যানাটোমির টেবিলে, কিন্তু তাঁর প্রত্যাখ্যান? তাকে ধরে রাখার মতো গভীর কলসপাত্র যে আমাদের কাছে নেই।
এ-ই হল সেই প্রত্যাখ্যানের নিজস্ব পৃথিবী...
Powered by Froala Editor