এ যদি আমার দেশ না হয়, তো...

কার দেশ বলো?

আমি হইলাম গিয়া সুটোবেলা থেইক্যাই বাঙাল। আমাগো বাসা আসিল ময়মনসিঙে। মানে আমার ফোরফাদারের বাসা আর কি! অহন সে বাসা আসে কি নাই, কইতে পারুম না। তবে, বাসা নাই তো কী, ভাষা তো আসে! ঠিক কিনা?

এই দেখুন, দু'লাইন বাঙাল বলতে পেরে কেমন মনটা ফুরফুরে লাগছে। অথচ, আমার ঠাকুর্দা, ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর এ ভাষায় বাড়িতে সর্বক্ষণের বক্তা কেউই নেই। কিন্তু, ঐ যে, বাসা যায়, ভাষা যায় না। প্রচণ্ড রেগে গেলে বাবা মাঝে মাঝেই বাঙাল বলতে থাকেন। আর আমি সেদিন প্রচণ্ড গতিতে বাঙাল বলতে শুরু করলাম ইস্টবেঙ্গল (East Bengal) ম্যাচ জেতার পরে। আমাদের বাড়িতে মায়ের গৃহকর্মে সহায়িকা মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে আমার দিকে। আসলে, উত্তেজনায় পেটের গুড়গুড় থেকে যে চোঁয়া ঢেকুরের বদলে একটা অদ্ভুত ভাষা হামাগুড়ি দিয়ে বেরোয় এ ওর কাছে একেবারে নতুন জিনিস। যে ভাষা বছরের পর বছর অব্যবহৃত, কিংবা হয়ত আলজিভ গড়ার থেকে কোনো কালে সে ভাষার উচ্চারণও হয়নি, সে বেরিয়ে আসছে, কোথা থেকে আসছে? কেনই বা আসছে? 

এক মণিপুরী তরুণ জোড়া গোল করলেন। নাম নাওরেম মহেশ সিং৷ ইস্টবেঙ্গল গত প্রায় একবছরে আই এস এলে একটি ম্যাচও জিততে পারেনি৷ এই ম্যাচে ওর জোড়া গোলে জিতল। তাতে অবশ্যি লিগটেবিলে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারল না। তবু, ম্যাচ শেষ হতেই টেলিফোন করে আমার এক প্রিয় লাল-হলুদ সুহৃদ বললেন— ‘আজ রাতে একটু শান্তিতে ঘুম হবে অর্পণ, অনেক অনেকদিন পর’; আমি মনে মনে মণিপুরের বাচ্চা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে যেন নেমে পড়ছি ভাঁটি গাঙের জলে৷ ভাষাশহিদের রক্তে হয়তো এখনো সে লাল। এই ছেলেটি হয়তো মৈতেই-তে কথা বলে, কিংবা থাডো বা তাংখুল। বাঙাল কখনোই বলে না, বোঝেও না। এদিন যে এগারোজন রক্তঘাম ঝরিয়ে ম্যাচটা জিতে ফিরল, অরিন্দম, রফিক মাঠের ধারে আনন্দে বসে দু'হাত তুলে চিৎকার করল;  একেবারে ভাঙাচোরা দল নিয়ে কোনোমতে একটা লাল হয়ে ওঠা আকাশ উপহার দিতে পারল অগণিত সমর্থককে তাঁরা সবাই ইস্টবেঙ্গল, ঐ যেমন বাঙাল ভাষা বেরিয়ে এল, তেমনই, কী আশ্চর্য নিয়তির লিখনকে স্রেফ লড়াই করে ভেতর থেকে ছেলেগুলো যা বের করে আনল, তা আসলে নিখাদ ইস্টবেঙ্গল।

আরও পড়ুন
তারা খসার দিনরাত

একুশ শতকের গোড়ায়, ইস্টবেঙ্গল শব্দটা আমার কাছে একটা নামই ছিল। কিংবা একটা ফুটবল ক্লাব। যত দিন গেল আমার মধ্যে জন্ম নিতে শুরু করল এক অন্য ইস্টবেঙ্গল। এই ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে অধিকাংশ সময়েই প্রত্যক্ষ যোগ রইল না ফুটবল ক্লাবের। বরং ভাষা আর বাসার যোগটা নিবিড় হল। ঠাকুমার গল্পে আমার তো দক্ষিণারঞ্জনের আলো আলো পৃথিবী ছিল না, ছিল শুধুই দেশভাগের গল্প। ঠাম্মা কোমরের কাছটা হাত দিয়ে দেখাতেন, বর্ডার পেরোনোর সময় পড়ে গিয়ে ভাঙা হাড়, আর জোড়েনি ঠিকভাবে, কুঁজো হয়ে গেলেন। একটা বিরাট দল, হাঁটছে শুধু হাঁটছে, রাতে ঘুপচি গোয়াল ঘর, বর্ডার পেরিয়ে লড়ির পিঠে চেপে শিয়ালদা, প্ল্যাটফর্মে রিফিউজিদের বিবাহ, সঙ্গম, জন্ম, মৃত্যুর প্যানোরামা দেখছি আমরা। ঐ বয়সে। আমাদের নিজস্ব ঠাকুমার ঝুলিতে। ইস্টবেঙ্গল। কলেজে উঠে আমার কাছে ইস্টবেঙ্গল মানে হল ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই।  ইস্টবেঙ্গল মানে কখন যেন মোহাম্মাদ আসাদুজ্জামান। বামপন্থী ছাত্রনেতা। সাতাশ বছর। হ্যাঁ, সেই আসাদ যাঁকে পাকিস্তানি পুলিশ ঊনসত্তরে রাস্তায় গুলি করে মারল। ইস্টবেঙ্গল মানে তখন আল মাহমুদের কবিতার লাইন—

আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া পাড়া-টারা

'কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে!
তোরাই তবে সোনামানিক/ আগুন জ্বেলে দে'

আরও পড়ুন
‘একবার বেঁচেছি দেবতা হয়ে’

অথচ আমার কান টেনে বারেবারে ইতিহাস দেখিয়ে দিতে চাইল, ইস্টবেঙ্গল একটা ফুটবল ক্লাব মাত্র। যার জন্ম ১৯২০ সালে এই কলকাতার বুকে। দেশভাগের অনেক আগে। উদ্বাস্তু আবেগের সঙ্গে এর যোগ নিবিড় হলেও প্রত্যক্ষ নয়। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে খুলনা, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় পড়তে আসত ছেলেরা। পূর্ববঙ্গের ছেলেদের কলকাত্তাইয়া নাম হল বাঙাল। ব্যঙ্গ করে৷ নিন্দাচ্ছলেও। বাঙাল শব্দটিকে যদি বঙ্গাল থেকে উৎপত্তি বলে ধরি তবে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলেও একে নিন্দাচ্ছলেই ব্যবহার করা হয়েছে। কলকাতার বুকে মোহনবাগান, কলকাতার বুকে শোভাবাজার। বনেদি পাড়া। দোতলা বাড়ি-মেস-প্রেস-প্রেস আর ট্রাম। বাঙাল সেখানে বেমানান। গৌড়ের লোকেরা তো বাঙালদের সহ্যই করতে পারতেন না, মেস ভাড়া দেওয়ার আগে দেখে নিতেন বাঙাল কিনা। বাংলা শব্দকোষে বাঙাল শব্দটির মানে তারা লিখে গেছেন— অশিক্ষিত৷ গেঁয়ো মানুষ। 

তবে এই অশিক্ষিত এই গেঁয়ো লোকেদের ফুটবল খেলার মাঠে হ্যাটা করা শুরু হতেই ইস্টবেঙ্গল জন্ম নিল। দেশের মধ্যে দেশ, দেশ মানে ভূ-খণ্ড নয় অস্তিত্ব। একরোখা বিদ্রোহ কখনো নিজেই গড়ে নেয় দেশের সীমানা। ইস্টবেঙ্গল সেই মুহূর্ত থেকে এক স্বতন্ত্র কমিউন, যেখান থেকে লালপতাকার মিছিল ছুটে যাবে কালের সীমানা পেরিয়ে। ভাষার জন্য, বাসার জন্য, খাদ্যের জন্য, অধিকারের জন্য৷ সে লড়বে। লড়েই যাবে। হারমান মেলভিলের উপন্যাস মবি ডিকের ক্যাপ্টেন আহবের মতো। ক্যাপ্টেন আহব একজন একপেয়ে নাবিক। একটা হারপুন নিয়ে ভেসে যাবে সমুদ্রে। তাড়া করবে এক অতিকায় তিমিকে। সে জিতবে না। কিন্তু ছাড়বেও না। টেনে হিঁচড়ে, শুধু টিকে থাকা। ইস্টবেঙ্গল একবছর পর যে ম্যাচটা জিতল, সেটাও এমন। প্রতিপক্ষের চার বিদেশি, স্প্যানিশ ছন্দ, পরিসংখ্যানের ওজনের সামনে কয়েকটা বাঁশ দিয়ে গড়া কেল্লা। জিতবে না। কিন্তু ছাড়বে না। ইস্টবেঙ্গল, এটাই। ঐ যে বাঙাল বেরিয়ে আসে, মাঝে মধ্যে, ভাষা শহিদের স্মৃতিসৌধে খসে পড়ে ক্লান্ত কাঁঠাল পাতা। 

বিশের দশকের মাঝামাঝি। ইস্টবেঙ্গল তখন সবে ময়দানে হামাগুড়ি দিচ্ছে। তাকে প্রাণপণে চেপে দিতে চাইছে শোভাবাজার, মোহনবাগান। এর মাঝেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সঙ্গে খেলা। ইস্টবেঙ্গলের রাজেন ঘোষ গান্ধী টুপি পরে খেলতে নামেন। জেভিয়ার্সের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ফিশার আপত্তি জানান। রাজেন একরোখা। মাথায় হাত দিয়ে বললেন—

'এ আমার দেশের গর্ব, এ টুপি আমি ছাড়ব না', তর্কাতর্কির মাঝে গান্ধীকে নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করে বসলেন ফিশার। ব্যস, ইস্টবেঙ্গল মাঠে বসে পড়ল। ক্ষমা না চাওয়া অবধি তাঁরা ম্যাচ খেলবে না, খেলতেও দেবে না। ব্রিটিশ পুলিশ, ফিরিঙ্গি জনতার চাপের পড়েও নড়ানো গেল না ইস্টবেঙ্গলকে। বিষয়টা এমন জায়গায় গেল যে ফাদার পপলেহার এসে ফিশারকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ান। ইস্টবেঙ্গল তারপর মাঠে নামে। আন্দোলনের ইতিহাস ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ওই সরাসরি একই খাতে মিশল। এরপর তো প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ধারাবাহিক ইতিহাস। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে প্রথম যেদিন ইস্টবেঙ্গল নামল লিগে, চাইনিজ ওয়াল গোষ্ঠ পালের সামনে সূর্য চক্কোত্তি, হারাণ সাহা, নেপাল চক্রবর্তী, ননী গোঁসাইরা। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল সেদিনও জিতেছিল। রীতিমতো লেমনেডের শিশি গলায় ঢেলে জানকবুল লড়াই!

ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাস নিয়ে পড়লে আর শেষ হবে না এ লেখা। আজ এই ঝাঁ চকচকে পণ্যায়িত আই এস এলের যুগে ইস্টবেঙ্গল নামটুকু বাদে বাকি কিছুই কি আর সেই অনুরণন তোলে? উত্তাল ছয়-সাতের দশকের ময়দানি চরিত্রেরা তো কবেই হারিয়ে গেছেন। ফুটবলার বা কোচ নয়, আমি এখানে বলতে চাইছি চরিত্রদের কথা, যাঁরা খেলাটার নাগরিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছিলেন, তাঁদের কথা। কোভিড অতিমারীর কারণে আই এস এল হচ্ছে গোয়ায়, দর্শকহীনভাবে, কতদিন চালানো সম্ভব জানে না কেউ। তবু, নিয়মমাফিক ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলেই টিভি চালাচ্ছে কেউ কেউ। রোজ হেরে যাবে জেনেও চালাচ্ছে। সেই টান, যা অমোঘ, যা পরোয়া করছে না দলের পারফরমেন্স কিংবা আলগা হতে থাকা বঙ্গফুটবলের ক্ষয়িষ্ণু কাঠামোর, তার শিকড়ে ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাসের মূলগুলি আঁকড়ে থাকে মাটি। নইলে কেনই বা এক মাঝ-তিরিশের যুবককে রাতে শান্তির ঘুম উপহার দেবে একটা সাধারণ ম্যাচ জয়, কিংবা কোন নাভিমূল থেকে আচমকা উঠে আসবে মাতৃভাষা? 

অনুভবে বুঝি। এই সমস্ত বিন্দু জুড়ে জুড়েই আসলে আমার দেশ। আমাদের মনের ভেতর সেই দেশ। তার কোনো পতাকা নেই। তার ভেতর ছলাৎ ছল নদী, আঁজলা ভরে জোছনা তুলে নিলে বেড়ে যায় ইছামতীর স্রোত। এক অখ্যাত মণিপুরী তরুণ দুটো গোল করে আমার এই দেশকেই জিতিয়ে দিল...

Powered by Froala Editor