তাঁর নামের পাশে কুড়িটা গ্র্যান্ডস্ল্যাম। বিশ্বজোড়া খ্যাতি। কোটি কোটি অনুরাগী। সেই সার্বিয়ান মহাতারকা নোভাক জকোভিচ (Novak Djokovic) যে দৃষ্টান্তখানা স্থাপন করলেন তাকে অপ্রত্যাশিত ভাবতে পারছি না। বরং এমনটা না করলেই যেন সময়ের দাবি এক অনিবার্য সমর্থন থেকে বঞ্চিত হত। বিগত কিছু বছরে আমাদের অন্যায়কে বুক বাজিয়ে উদযাপনের যে প্রবণতা জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক হতে চাইছে, সেই ট্রেন্ডের পিছনে অদৃশ্য সমর্থনের হাতটুকুই তো রাখলেন জকোভিচ। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে খেলতে এলেন কোভিড প্রতিষেধক না নিয়ে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী তাঁর কাছে বিশেষ ছাড়ের মাধ্যমে টুর্নামেন্টে খেলার অনুমতি রয়েছে। অস্ট্রেলিয় সরকার এই ছাড় মানতে নারাজ। সেখানকার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ঘোষনা করে দিয়েছিলেন সকলের জন্য আইন সমান, দেশে দৈনিক সংক্রমণ সত্তর হাজার, ফলে জকোভিচের বিশেষ ছাড় এক অসাম্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। নাছোড় জকোভিচ আদালতে গিয়ে তাঁর দাবি আদায় করলেন। শুধু করলেন তা-ই নয়, ইনস্টাগ্রাম বিবৃতিতে ঘোষণা করলেন, তিনি ডিসেম্বর মাসে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরের দিন মাস্কহীন অবস্থায় নিজের নামের ডাকটিকিট প্রকাশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। একটি ফরাসি ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, মাস্ক খুলে ফটোশ্যুটও করেছেন। কেন জানি না, আশ্চর্য হইনি এ ঘটনায়। উপরন্তু তাঁর ইন্সটাপোস্টের তলায় বহু বহু মানুষ তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে বিস্মিত না হওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়। প্রতিবাদ বা বিরোধিতা হয়তো করছেন অনেকে, শেন ওয়ার্নের মতো তারকা সরব হয়েছেন।
জকোভিচ কাদের প্রতিনিধি, কোন সময়ের প্রতিনিধি এ প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকা আশু প্রয়োজন। আর এখানেই পরাবাস্তবতা বা সাররিয়্যালিজমের মোড়কের ভেতর সাদাকালো বাস্তবকে অস্বীকারের জায়গা নেই। জকোভিচ যা করলেন, তা তো হিমশৈলের চূড়া মাত্র। সাহিত্য-চলচ্চিত্র-খেলাধূলা কিংবা যেকোনো ক্ষেত্রে তারকা-মহাতারকা হয়ে ওঠার যে মার্গ, তা আদতে সমাজ ও সময়ের সূচকের মাঝে এক কম্পমান রেখা। পরিপার্শ্বকে অস্বীকার করে যা দৃশ্যমান হতে পারে না। এ স্বীকারোক্তির পরেও নোভাক খেলতে চাইছেন গ্র্যান্ডস্ল্যামে। অর্থাৎ বিষয়টি এমন যে অনৈতিকতাকে সচেতনভাবে গ্রহণ করাই দস্তুর। ন্যায় ও নীতি নামক যে দুটি ব্যাঙের ছাতা মানব সমাজকে এতকাল বে-আব্রু হওয়া থেকে ঢেকে রাখল, তাকে উপড়ে ফেলা হয়ে উঠছে সময়ের দাবি। দিন কয়েক আগে খবরের কাগজে পড়লাম বুল্লি-বাই নামক একটি অ্যাপের কথা। ওই আন্ড্রয়েড অ্যাপের মাধ্যমে মুসলিম মহিলাদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে পণ্য হিসেবে নিলামে তোলা হচ্ছে। এই অ্যাপের মূলচক্রী একটি কুড়ি বছরের ছেলে। তথ্যপ্রযুক্তির ছাত্র। অসম থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর সে নিজে মুখে স্বীকার করেছে তার কৃতকর্মের কথা। এও জানিয়েছে যে, এই কাল্পনিক নিলামের যে বে-আইনি প্রক্রিয়া, তার মূল কাণ্ডারি হিসেবে সে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়। নীতি কিংবা আদর্শের পলেস্তারা খসে যাওয়ার যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সে দেখছে তার প্রেক্ষিতে তার মনে হয়েছে যে এই কাজ সময়োপযোগী।
এক টিনেজারের মনে এই ধারাবাহিক বিকৃতির পিছনে আমরা যদি একটি কাল্পনিক আয়না বসাই তবে তাতে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে আমাদের স্বাভাবিক হতে থাকা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি ধারাবাহিক চিত্র। রাজনৈতিক দল ও মত নির্বিশেষে এ কথা আমরা সকলেই জানি যে, এ বিশ্বের শতকরা পঁচাত্তরভাগ রাজনীতিবিদই কোনো না কোনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত। আমেরিকা বা ইউরোপে এই সব কেষ্টবিষ্টুদের কেলেঙ্কারির খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় মাঝে মাঝেই হইচই ফেলে দেয়। এ দেশেও বিধানসভা বা সংসদের সদস্যদের মধ্যে এমন মানুষ বিরল, যাঁদের নামে খুন, ধর্ষণ বা আর্থিক দুর্নীতির কোনো মামলা নেই। এই সমস্ত নেতারা নিশ্চিতভাবেই জানেন যে তাঁদের কৃতকর্মের বিষয়ে জনগণ অবগত। কিন্তু এরপরেও তাঁরা বহাল তবিয়তে সারাবছর প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যেন শিক্ষিত মানুষের সামনে তারা প্রস্তুত করেছেন এক উঁচুনিচু কুমিরডাঙার দালান, যেখানে মৃতপ্রায় কুমিরের থুড়ি জনতার সামনে এসে তারা সমস্ত অন্যায্য-অনৈতিক-অসামাজিক কীর্তির পশমিনা আলোয়ান চাপিয়ে দিব্বি নেচে বেড়াতে পারেন। বছর কুড়ির ছেলেটিকে তাঁর কৈশোরে আমরা তো উপহার দিতে পেরেছি এই সুশীল সমাজ। দিন কয়েক আগে সুদানের সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পথে নেমে প্রতিবাদ করায় একটি ষোলো বছরের ছেলেকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হল। রাজধানী খার্তুমে প্রকাশ্য রাস্তায় সেনার হাতে খুন হচ্ছেন গণতন্ত্রকামী মানুষ। নির্লজ্জের মতো হাল্লার সেনারা হাসপাতালে যাওয়ার পথে আটকে দিচ্ছেন আম্বুলেন্সের পথ। রাজনৈতিক নেতারা বন্দি, ইউনাইটেড নেশনের এক কর্তাকে গুম করে ফেলা হয়েছে। সুদানিজ সেনা বাহিনীর প্রধান আল-বুরহানকে কড়া বার্তা পাঠাচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। অথচ এই মানুষটি গণহত্যার পরেও নির্লিপ্তভাবে জানাচ্ছেন যে, দেশে যা হচ্ছে তার একমাত্র দাওয়াই হল বুলেট! একথা বলতে তিনি বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করছেন না।
নোভাক জকোভিচের কথায় ফেরা যাক। আমরা জানি না তিনি অস্ট্রেলিয় ওপেনে মাঠে নামবেন কিনা। সে সিদ্ধান্ত নেবে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। তিনি যে গর্হিত কোনো অপরাধ করেছেন, এমন দাবি করা চলে না। জনপ্রিয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে লেখা দেখলাম এই মর্মে যে নোভাকের কাছে জনমানসের যা প্রত্যাশা, যে আইকনত্বের দায় তাঁর কাঁধে— সেই দায় তাঁকে কেন পরিশীলিত ও সংযত আচরণে বাধ্য করল না? এ প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই আসলে জুড়ে যায় উপরের সবক’টি বিন্দু। আসামের বছর কুড়ির তরুণ থেকে আল-বুরহান। নোভাক জকোভিচ তো লালকার্পেটের পৃথিবীর পাশে সুসজ্জিত শপিং মলে থাকা কোনো ম্যানিকুইন নন, তিনি এই বিশ্বের অগণিত জনতার ধুলো-মাটি-জল থেকেই উঠে আসা এক তারা। বিগত দশকে ক্রমে ক্রমে যে চরিত্র পাল্টালো জনমানসের, যেখান থেকে সে স্বাভাবিক করে ফেলতে চাইল সামাজিক মূল্যবোধ ও দায়িত্বের অবক্ষয়গুলো, জকোভিচ ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে সেই জনতারই প্রতিনিধি। আমেরিকায় নাকি তরুণ-তরুণীরা মাস্ক পরতে চাইছেন না। রীতিমতো ক্ষোভ দেখাচ্ছেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। গতকাল টিভিতে দেখলাম বাবুঘাটে এক গঙ্গাসাগর যাত্রীকে মিডিয়ার এক প্রতিনিধি মাস্কহীন অবস্থায় ধরায় সে বলছে— ‘মাস্ক ফাস্ক পরে আর থাকা যাবে না, ছাড়ুন তো এসব নাটক!’; আর সেই ব্যক্তির কয়েক হাত নাগালের ভেতর দাঁড়িয়ে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার। ভেবে দেখুন, একজন প্রশাসনিক পদাধিকারীর সামনে দাঁড়িয়ে একজন সহনাগরিক একথা বলছেন যিনি কয়েকমাস আগেই দেখেছেন কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ।
আরও পড়ুন
গৃহযুদ্ধে বিরতি, আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট ঘিরে ঐক্যবদ্ধ ক্যামারুন
কাকে ন্যায় বলব আর কাকে অন্যায়? সত্যিই তো, নোভাক জকোভিচ কোন সামাজিক দায়ে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে আড়াল করবেন? কাদের জন্য করবেন? কেনই বা করবেন?
আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া পাড়া-টারা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
‘একবার বেঁচেছি দেবতা হয়ে’